OrdinaryITPostAd

অতিপ্রাকৃতিক বিষয়গুলো কেন আমাদের আকৃষ্ট করে?

ভূত-প্রেত, জীন-পরী, রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারের কাহিনি, টিভি শো, সিনেমা এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রের মতো অতিপ্রাকৃত বিষয়গুলি এখনও মানুষের কল্পনাকে মোহিত করে রাখে। বর্তমান যুগের অভূতপূর্ব বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও বস্তুবাদের যুগেও, মানুষ ব্যাখাতীত জগৎকে ঘিরে এক অদ্ভুত টান অনুভব করে থাকে।  

অতিপ্রাকৃতিক-বিষয়গুলো-কেন-আমাদের-আকৃষ্ট-করে
এই চিরন্তন আকর্ষনের পেছনে রয়েছে সময়ের সীমানা ছাড়িয়ে টিকে থাকা গভীর মনস্তাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক এবং অস্তিত্বমূলক অনেক কারন। যুক্তি ও তথ্যের প্রভাবে চলা বর্তমান পৃথিবীতে অতিপ্রাকৃত বিষয়গুলো মানুষের মনে এক ধরনের রহস্য, সান্ত্বনা এবং বিস্ময় প্রদান করে, যা কেবল বৈষয়িক জিনিস দিয়ে পূরণ করা যায় না। 

সূচিপত্রঃ অতিপ্রাকৃতিক বিষয়গুলো কেন আমাদের আকৃষ্ট করে

অতিপ্রাকৃতিক বিষয়ের প্রতি আকর্ষন বোধ করার মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো

অতিপ্রাকৃত বিষয়ের প্রতি আমাদের স্বভাবজাত আর্কষনের মুলে রয়েছে বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক কারন। মানুষ স্বভাবতই কৌতূহলী এবং এর ফলে আমরা অজানার ব্যাখ্যা খুঁজে বেড়াই। যখন আমরা রহস্যময় বা আমাদের বোঝার বাহিরে এমন কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হই, তখন আমাদের মস্তিস্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা বোঝার জন্য প্যাটার্ন বা অর্থ খোঁজে।   

মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, এই প্যাটার্ন খোঁজার প্রবনতাকে অ্যাফোফেনিয়া (Apophenia) বলা হয়ে থাকে। এর ফলে আমাদের মন এমন ভিন্ন ভিন্ন দুইটি জিনিসের মধ্যে এমন সম্পর্ক বের করে যার বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নেই - যেমন, মেঝেতে পড়ে থাকা দড়িকে সাপ মনে করা, বাতাস বা অন্য কোন কারনে কাঁপতে থাকা ছায়াকে ভুতের ছায়া বলে ভুল করা, বা সাধারন ঘটনাকে ঈশ্বর প্রেরিত সংকেত বলে মনে করা। সবসময় যুক্তিপূর্ন না হলেও এই প্যাটার্ন খোঁজার প্রবণতা মানব মস্তিস্কের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। 
 
ভয়ও অতিপ্রাকৃতের প্রতি আকর্ষনে বড় ভূমিকা রাখে। ভয়, রহস্য বা অজানাকে ঘিরে গড়ে ওঠা গল্প আমাদের মস্তিষ্কে ফাইট-অর-ফ্লাইট (fight-or-flight) প্রতিক্রিয়া সক্রিয় করে তোলে। এইসব গল্প যদি সিনেমা, নাটক বা বই পড়ার মতো নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে উপভোগ করা যায়, তাহলে তা আমাদেরকে ভয়ের এক নিরাপদ ও উত্তেজনাপূর্ণ অভিজ্ঞতা এনে দেয়। 
 
নিজে নিরাপদ থেকে ভয় পাওয়ার অনুভূতি উপভোগ করা - এরকম প্যারাডক্স বা বৈপরীত্য মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমাদের জন্য সন্তোষজনক হয়। এটি আমাদেরকে বাস্তবে কোন ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছাড়াই আমাদের ভয় ও উত্তেজনা ভালোভাবে চেখে নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। এক দিক থেকে দেখতে গেলে এটি রোলার কোস্টারে ওঠার মত ব্যাপার - ভয়ের স্বাদ পেলেও মানুষ আসলে কোন বিপদের মুখে পড়ে না।  

অতিপ্রাকৃত বিষয়ে বিশ্বাস অনেক সময়ে আমাদেরকে মানসিক সান্ত্বনা দেয়। মৃত্যু পরবর্তী জীবন, আমাদেরকে বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য নিয়োজিত দেবদূত বা আমাদের জীবনে আমাদের পক্ষে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের মতো ধারনা আমাদের মৃত্যুভয়, একাকীত্ব বা জীবনের অনিশ্চয়তা কমিয়ে দিতে সাহায্য করে। বিশেষ করে শোক, সংকট বা অনিশ্চিত সময়ে এই বিশ্বাসগুলো আমাদের মনে আশা ও মানসিক স্থিতি এনে দেয়। 
 

গল্প বলার ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা

সংস্কৃতি অতিপ্রাকৃতের প্রতি আমাদের আগ্রহ টিকিয়ে রাখতে একটি শক্তিশালী উপাদান হিসেবে কাজ করে থাকে। প্রাচীন কালের মিথ, কিংবদন্তি ও আধ্যাত্মিক বিশ্বাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়ে আমাদের সম্মিলিত চিন্তাধারাকে গড়ে তুলেছে। সমাজ যতই আধুনিক হোক না কেন, এই গল্পগুলো হারিয়ে যায় না, বরং তারা নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। 

প্রাচীন অতিপ্রাকৃত চরিত্রগুলো সময়ের সাথে সাথে রূপান্তরিত হয়েছে। যেমন, পূর্ব ইউরোপের পুরনো ভ্যম্পায়ার কাহিনি সাহিত্যিক চরিত্র ড্রাকুলা হয়ে উঠেছে, এরপর আধুনিক যুগে Twilight বা The Vampire Diaries - এর মতো সিরিজে রূপ পেয়েছে। ঠিক সেভাবেই, এক সময়ে ইউরোপে ভয় ও নিপীড়নের শিকার হওয়া ডাইনিরা আজ Harry PotterChilling Adventures of  Sabrina -এর মতো গল্পে শক্তিশালী ও সম্মানিত চরিত্রে পরিণত হয়েছে। 

গল্প, সাহিত্য ও শিল্পকলা ঐতিহ্যগতভাবেই অতিপ্রাকৃত ভাবনার বহিঃপ্রকাশের বড় মাধ্যম হয়ে এসেছে। এগুলো আমাদেরকে ভালোবাসা, মৃত্যু, ন্যায়বিচার ও নিয়তির মতো সার্বজনীন মানবিক অভিজ্ঞতা চেখে দেখার সুযোগ করে দেয়। অতিপ্রাকৃত উপাদানগুলো এই সব বিষয়কে কল্পনাপ্রবন এবং অভিনব উপায়ে ব্যাখ্যা করার একটি চমৎকার দৃষ্টিভঙ্গি দান করে থাকে। 

এই উপাদানগুলো শক্তিশালী রুপক হিসেবেও বিবেচিত হয়ে থাকে। উদাহরন স্বরূপ, একটি ভূত আমাদের অবদমিত শোক বা অতীতের না মেটানো যন্ত্রণার প্রতীক হতে পারে। আর একটি রাক্ষস বা দানব আমাদের ভেতরের ভয়, অপরাধবোধ বা মানসিক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন ঘটাতে পারে। 

সবশেষে, বিনোদনের দিক থেকেও অতিপ্রাকৃত ব্যাপক জনপ্রিয়। এর মাধ্যমে আমরা টাইম ট্রাভেল করা যাদুকর থেকে শুরু করে ভৌতিক মহাকাশযান পর্যন্ত সীমাহীন কল্পনার জগৎ তৈরি করতে পারি। এইসব গল্প আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দিয়ে বাস্তব আর কল্পনার এক আকর্ষনীয় মিশ্রন উপহার দেয়। 
 
অতিপ্রাকৃতিক-বিষয়গুলো-কেন-আমাদের-আকৃষ্ট-করে

 

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং জীবনের অর্থ খোঁজা

মজার ব্যাপার হচ্ছে, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত ক্রমাগত অগ্রগতি অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসকে কমিয়ে না দিয়ে বরং কিছু ক্ষেত্রে তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ইন্টারনেট অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসকে দ্রুত বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ভুতের ভিডিও, যড়যন্ত্র তত্ত্ব, জ্যোতিষ শাস্ত্র বিষয়ক কন্টেন্ট এবং অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতা নিয়ে ব্যাক্তিগত কাহিনিতে ভরে গেছে। 

এই প্ল্যাটফর্মগুলোর অ্যালগরিদম এমন কন্টেণ্টকে প্রাধান্য দেয় যা মানুষের মনে শক্তিশালী আবেগ সৃষ্টি করে। অতিপ্রাকৃত বিষয়গুলো প্রায়ই ব্যবহারকারীদের মাঝে বিস্ময়, ভয় বা কৌতুহল জাগায়, যা ঐসব বিষয়কে মানুষের কাছে আরও জনপ্রিয় করে তোলে। ফলে, এই ধরনের কন্টেন্ট আরও বড় সংখ্যক শ্রোতার কাছে পৌঁছায় এবং তা এক ধরনের সাংস্কৃতিক প্রভাব তৈরি করে। 

প্রযুক্তিগত উন্নয়ন মাঝে মাঝেই জগৎ ও জীবনের বিভিন্ন রহস্য সমাধান  করার বদলে তাদেরকে আরও গভীর করে তোলে। বিজ্ঞান আমাদেরকে কিভাবে কিছু ঘটে তার ব্যাখ্যা দেয় কিন্তু একটা জিনিস কেন ঘটে, সে প্রশ্নের গভীর দার্শনিক বা অস্তিত্বমূলক উত্তর সন্তোষজনকভাবে দিতে পারে না। আমরা যত বেশি জানতে পারি, ততই আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের কাছে আরও কত কিছু অজানা রয়ে গেছে, আর এই জায়গাটাই অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যা দখল করে নেয়। 

আধুনিক প্রযুক্তি প্রাচীন অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসকে নতুনভাবে ফিরিয়ে আনছে এবং তা আমাদের সামনে নতুনভাবে উপস্থাপন করছে। দৈনিক রাশিফল, ট্যরোট রিডিং এবং অ্যাধ্যাত্বিক বার্তা এখন মোবাইল অ্যাপে সহজেই পাওয়া যায়। এই প্রযুক্তিগুলো পুরোনো মিস্টিক প্রথাগুলোকে আরও সহজলভ্য ও ব্যাক্তিকেন্দ্রিক করে তুলেছে। 

প্রযুক্তি ও অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসের মিশ্রন বিনোদনের সম্পূর্ন নতুন অভিজ্ঞতা তৈরি করছে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে একজন ব্যাক্তি ভূত, প্রেত দ্বারা আক্রান্ত হবার অনুভূতি পেতে পারেন, আবার মৃত ব্যাক্তির ডিজিটাল যোগাযোগ থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া চ্যাটবটের মাধ্যমে তাদের সাথে "যোগাযোগ" করা হচ্ছে। পুরানো বিশ্বাস আর আধুনিক প্রযুক্তির এই সংমিশ্রন ডিজিটাল যুগে আমাদেরকে অতিপ্রাকৃতকে জানার নতুন নতুন পথ খুলে দিচ্ছে। 

অস্তিত্ববাদ এবং মানব অবস্থার ভূমিকা

অতিপ্রাকৃত বিষয়গুলোর প্রতি মানুষের আকর্ষনের মূলেই রয়েছে মানুষের অর্থ খোঁজার মৌলিক প্রয়াস। জীবনের ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতি এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে আমদের সচেতনতা আমাদেরকে অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা করে রেখেছে। এই সচেতনতা থেকেই আমাদের মনে আমাদের অস্তিস্ত্ব নিয়ে নানারকম প্রশ্নের ( যেমনঃ এই পৃথিবীতে আমরা কেন জন্মগ্রহন করেছি? মৃত্যুর পর কি ঘটে? কোনো বড় শক্তি কি আমাদের উপর নজর রাখছে?) জন্ম নেয়। 
 
অতিপ্রাকৃতের উপর বিশ্বাস অনেক সময় এসব গভীর ও ব্যাক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দেয়। ধর্ম, আধ্যাত্বিকতা বা লোককথার মাধ্যমে মানুষ এসব প্রশ্নের এমন ব্যাখ্যা খোঁজে যা তাদের কল্পনাকে বাস্তব জগতের সীমার বাইরে নিয়ে যায়। এই বিশ্বাসাগুলো মানুষের আবেগগত ও দার্শনিক শুন্যতা পূরনে সাহায্য করে, যা যুক্তিবাদ সবসময়ে দিতে পারে না।   

অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস মানুষের পরিচয় এবং সামাজিক সংযোগের উৎস হতে পারে। অনেক সময় মানুষ কোন বিশেষ অতিপ্রাকৃত বিষয় - যেমন কোন অতিপ্রাকৃত টিভি সিরিজের ভক্ত গোষ্ঠী বা কোন আধ্যত্বিক গুরুর অনুসারীরা - ঘিরে একত্রিত হয়ে থাকে। এসব গোষ্ঠী মানুষের একাকীত্ব দূর করে এবং তাদেরকে নিজেদের চাইতে বড় কিছুর অংশ হওয়ার অনুভূতি দেয়।
 
কঠিন সময়ে অতিপ্রাকৃত বিষয়ের প্রতি মানুষের বিশ্বাস বেড়ে যায়। মহামারী, যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো অনিশ্চিত সময় মানুষকে ইশারা, রীতিনীতি বা কাহিনীর মাধ্যমে সান্ত্বনা খোঁজার দিকে ঠেলে দেয়। সংকটে অতিপ্রাকৃতের উপর বিশ্বাস অনেকের কাছে অযৌক্তিক মনে হলেও , আসলে এটি একটি মানবিক পদ্ধতি, যার মাধ্যমে মানুষ তার নিজের জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ ও অর্থের অনুভূতি বজায় রাখার চেষ্টা বা ভান করে নিজের মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখে।  

উদাহরনস্বরূপ, কোভিড-১৯ মহামারীর সময় সারা বিশ্বে জ্যোতিষশাস্ত্র, ট্যারোট রিডিং এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রতি আগ্রহ বেড়েছিল। বিশ্ব যখন অনিশ্চিত ও বিশৃঙ্খল হয়ে উঠেছিল মানুষ তখন এসবের মধ্যে অর্থ ও দিকনির্দেশনা খুঁজেছে। সেই সময় অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস ভয়, বিভ্রান্তি এবং অজানার মধ্যে পথ খুঁজে নেবার একটি মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। 

অতিপ্রাকৃত এবং নিজেদের আত্ম-প্রতিচ্ছবি

অতিপ্রাকৃতের প্রতি মানুষের স্থায়ী আকর্ষনের আরেকটি শক্তিশালী কারন হলো এটি রুপকভাবে একটি আয়না হয়ে আমাদের সামনে আমাদের আসল স্বভাবকে ফুটিয়ে তোলে। অতিপ্রাকৃত গল্পগুলো অনেক সময় আমাদের মনের গভীরে চলমান সংঘাতগুলোকে বাহ্যিকভাবে প্রকাশ করে। একটি ভুতুড়ে বাড়ি দমিয়ে রাখা স্মৃতি বা অপরাধবোধের প্রতীক হতে পারে, আবার একটি অভিশপ্ত বস্তু কোন জিনিসের প্রতি আমাদের গভীর আবেগগত আসত্তির প্রতিরুপ হতে পারে। 

অতিপ্রাকৃত গল্পের প্রধান চরিত্রের নেকড়ে মানব বা ভ্যাম্পায়ারে রূপান্তরের মতো অতিপ্রাকৃতিক পরিবর্তনগুলো প্রায়ই মানুষের পরিচয় সংকট বা আবেগত অস্থিরতার প্রতিফলন ঘটায়। এই ধরনের গল্প মানুষকে তাদের ভয় এবং আকাঙ্খা প্রতীকীভাবে অন্বেষন করার সুযোগ করে দেয়। এগুলো এমন সব অনুভুতিকে বাস্তব রূপ দেয় যা সাধারন জীবনে প্রকাশ করা কঠিন। 

সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে অতিপ্রাকৃত উপাদানগুলো প্রায়ই প্রধান চরিত্র বা চরিত্রগুলোর নৈতিক ধারনাকে চ্যালেঞ্জ করে থাকে। এসব গল্প বলার মাধ্যমে চরিত্রদের এমন পরিস্থিতিতে ফেলা হয় যেখানে তাদের এবং পরোক্ষভাবে দর্শকদের জটিল নৈতিক সিদ্ধান্তের মুখোমুখি  হতে হয়। এসব জটিল পরিস্থিতিগুলো আমাদের আচরণের ধূসর অঞ্চলগুলোকে দর্শকদের কাছে উন্মুক্ত করে দেয় এবং আমাদের সাদাকালো, সরল নৈতিকতার ধারনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। 

অতিপ্রাকৃত মানুষকে তাদের ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে গভীর দার্শনিক চিন্তা ও প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করে। ঈশ্বর, আত্মা বা অদৃশ্য শক্তির প্রতি বিশ্বাস মানুষকে তাদের আচরন, সম্পর্ক এবং চিন্তাধারাকে আরও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করতে প্ররোচিত করে। 
 
অবিশ্বাস বা অ্যাধ্যাত্মিকতা- যেই ভিত্তিতেই হোক না কেন- অতিপ্রাকৃত নিজেকে আবিস্কারের একটি চমৎকার উপকরন হিসেবে কাজ করে। এটি মানুষকে নিজের মনের গভীরে তাকাতে উৎসাহিত করে। এইভাবে, ভয়ের গল্পগুলো অর্থবহ আত্ম অন্বেষণের যাত্রায় রূপ নেয়।  
 
অতিপ্রাকৃতিক-বিষয়গুলো-কেন-আমাদের-আকৃষ্ট-করে

 

আধুনিক রুপান্তর ও বাণিজ্যিক সাফল্য

বর্তমান যুগে অতিপ্রাকৃত বিষয়গুলো শুধু টিকেই নেই, বরং সেগুলো বাণিজ্যিকভাবে সফলভাবেই বিকাশ লাভ করেছে। The Conjuring, Hereditary এবং Insidious - এর মতো চলচ্চিত্রগুলো বক্স অফিসে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে এবং তারা একইসাথে অতিপ্রাকৃত কাহিনীর ধরনকে আমাদের সামনে নতুনভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে নেটফ্লিক্স এবং অ্যামাজন প্রাইম এর মতো স্ট্রিমিং পরিষেবাগুলো এলিয়েন, ভূত-প্রেত, এবং সাইকিক শক্তির উপর নির্মিত ডকুমেন্টারি প্রচার করে চলেছে। 

উন্নত বিশ্বে প্রকাশকেরা আজকাল নিয়মিত এমন সব বেস্টসেলার প্রকাশ করছে যেগুলোর মূল বিষয় জাদুবিদ্যা, পুনর্জন্ম ও রহস্যবাদ। এসব বিষয়বস্তু যেসব পাঠক তাদের জীবনের একঘেয়ে বাস্তবতা থেকে মুক্তি চাইছেন অথবা যারা জীবনের গভীর অর্থ খুঁজছেন তাদেরকে বিশেষভাবে মোহিত করে থাকে। এই ধরনের বইয়ের নিয়মিত প্রকাশ পাঠকদের অতিপ্রাকৃত বিষয়গুলো নিয়ে ক্রমাগত চাহিদাই প্রমান করে। 
অতিপ্রাকৃত বিষয়গুলোর বাণিজ্যিক সাফল্য কাকতালীয় নয়, বরং এদের চাহিদাকে কৌশলগতভাবে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা হয়েছে। বিপনন কৌশলগুলো প্রায়ই আমাদের ভয়, বিস্ময়, এবং কৌতূহল এর মতো মানসিক ও আবেগগত অনুভূতিগুলোর ওপর কাজ করে। এই অনুভূতিগুলো অতিপ্রাকৃত বিষয়বস্তুদের মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে রপান্তর সহজ করে।  

সেইজন্যেই আজকাল চলচ্চিত্র, বই, ভিডিও গেম, পডকাস্ট এবং অন্যান্য বিনোদন মাধ্যমে অতিপ্রাকৃত বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যমে অতিপ্রাকৃতের এই রকম ব্যাপক উপস্থিতি বিষয়টির সাংস্কৃতিক প্রভাবকে আরও মজবুত করে চলেছে এবং এর সাথে জড়িত লোকেদের আয় করার একটি ধারাবাহিক উৎসে পরিণত হয়েছে। ভোক্তাদের বিনোদনের চাহিদা মিটিয়ে এবং তাদের চাহিদা অনুযায়ী কন্টেন্ট বানানোর মাধ্যমে, অতিপ্রাকৃত বিষয়গুলোকে ঘিরে একটি লাভজনক অর্থনীতি গড়ে উঠছে। 

এর ফলে, আধুনিক মননে অতিপ্রাকৃত এক দৃঢ় অবস্থান অর্জন করেছে। মানুষ শুধু এই গল্পগুলো উপভোগ করে না - তারা এর সাথে নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলে এবং কখনো কখনো এই গল্পগুলো বিশ্বাসও করে ফেলে। সময়ের সাথে সাথে এই বিশ্বাসগুলো ব্যাক্তিগত ও সামষ্টিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সূক্ষ্ণ অথচ গভীরভাবে প্রভাবিত করে। 
 

শেষ কথা

আজকের পৃথিবীতে অতিপ্রাকৃত বিষয়গুলোর প্রতি আকর্ষন শুধু প্রাচীন অজ্ঞতার চিহ্ন নয়। বরং এটি আমদের গভীর মানসিক চাহিদা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, অস্তিত্বগত উদ্বেগ এবং গল্প বলার সৃজনশীল নমনীয়তার প্রতিফলন ঘটায়, যা আবার মিডিয়া, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্বারা গঠিত হয়েছে। 
 
আমাদের এই বিশৃঙ্খল ও নিস্প্রান পৃথিবীতে অতিপ্রাকৃতের উপর বিশ্বাস মানুষকে ব্যাক্তিগত অর্থ, আবেগীয় মুক্তি এবং কল্পনার জগতে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। কেউ ভূত প্রেতে বিশ্বাস করুক বা না করুক, অতিপ্রাকৃতিক বিষয়গুলো এখনও মানুষকে মুগ্ধ করে, কারন এটি আমাদের বাস্তবতার সীমানা অতিক্রম করে বোঝার ও অন্বেষণের মৌলিক চাহিদাকে স্পর্শ করে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ২

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৩

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৪