ভয়ের মনস্তত্ত্ব

ভয় মানবজাতির সবচেয়ে প্রাচীন এবং শক্তিশালী আগেবগুলোর মধ্যে একটি, যা শারীরিক এবং মানসিক বিপদে পড়লে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া হিসাবে কাজ করে। এটি ছাড়া আমরা প্রকৃত হুমকি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারতাম না।  
 
ভয়ের-মনস্তত্ত্ব
তবে শুধু টিকে থাকার প্রবৃত্তির বাইরেও ভয়ের একটি জটিল মনস্তাত্ত্বিক দিকও রয়েছে। ভয় আমাদের মনে কিভাবে বিকাশ লাভ করে, এবং তা আমাদের আচরন ও চিন্তাধারাকে কেমন করে প্রভাবিত করে, তা বিশ্লেষণ করলে ভয়ের উপকারি ও ক্ষতিকর এই দুটো দিকই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।  
 

সূচিপত্রঃ ভয়ের মনস্তত্ত্ব  


ভয়কে সংজ্ঞায়িত করা 

ভয়কে সাধারনত একটি অনুভূত হুমকির (a perceived threat) প্রতি মানসিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়ে থাকে। এটি একটি মৌলিক প্রতিক্রিয়া যা মানুষকে বিপদ চিনতে এবং কেউ বিপদে পড়লে তার ডাকে সাড়া দিতে সহায়তা করে। এই আবেগ প্রায় সকল স্তন্যপ্রায়ী প্রাণীদের মধ্যে পর্যবেক্ষেন করা গেছে, এবং এটি দেহ ও মন উভয়কেই প্রভাবিত করে থাকে। 

একজন মানুষ ভয় পেলে তার দেহ ও মনে নানা রকম পরিবর্তনের একটি ধারা শুরু হয়। হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, অনুভূতির তীব্রতা প্রখর হওয়া, এবং রক্তে অ্যাড্রেলিন হরমোনের প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়া এরকম কিছু পরিবর্তন নির্দেশ করে। এসব প্রতিক্রিয়া শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ হয়ে থাকে। 

নিজেকে বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য এরকম শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত হবার প্রক্রিয়াকে ফাইট-অর-ফ্লাইট (fight or flight) প্রতিক্রিয়া বলা হয়ে থাকে। এটি আমাদেরকে হয় হুমকিকে সামনা সামনি মোকাবেলা করতে, নয়তো দ্রুত পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। এই প্রতিক্রিয়া আমাদেরকে বাস্তব বিপদের মুখে টিকে থাকার জন্য বিবর্তিত হয়েছে। 

তবে সব ভীতিকর অভিজ্ঞতাই যে বাস্তব বা তাৎক্ষনিক বিপদ থেকে জন্ম নেবে এমন কোন কথা নেই। মানুষেরই অনেক ভয়ই পূর্বঅনুমানভিত্তিক বা কল্পনাপ্রসূত। এসব ভয়ে শারীরিক ক্ষতির ঝুঁকি না থাকলেও এর আবেগগত প্রতিক্রিয়া তীব্র হতে পারে। 

উদাহরনস্বরূপ, সবার সামনে কথা বলার ভয়, কোন কিছুতে ব্যার্থ হবার ভয় অথবা প্রিয়জনের কাছে প্রত্যাখ্যাত হবার ভয় সাধারনত তাৎক্ষনিক ভাবে এবং নিকট ভবিষ্যতে আমাদেরকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয় না। তারপরেও, এই ভয়গুলোর মানসিক ও শারীরিক প্রতিক্রিয়া বাস্তব বিপদের মতোই প্রবল হতে পারে। এতে প্রমানিত হয় যে ভয় নামের অনুভূতি মানুষের মনের যুক্তিসংগত এবং অযৌক্তিক উভয় স্তরেই কাজ করে থাকে। 

নিউরোসাইন্স অনুযায়ী ভয় পাবার কারন

নিউরোসাইন্স অনুযায়ী ভয় পাবার অনুভূতি মানব মস্তিস্কের অ্যামিগডালা (amygdala) নামের অংশ থেকে সৃষ্টি হয়ে থাকে, যা মস্তিস্কের টেম্পোরাল লোবের (temporal lobe) গভীরে অবস্থিত বাদাম আকৃতির এক জোড়া অঙ্গ। অ্যামিগডালা হুমকি শনাক্ত করতে এবং তা মোকাবেলা করার জন্য দেহ ও মনকে তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা যখন কোন সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করতে পারি, তখন অ্যামিগডালা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ভয়ের প্রতিক্রিয়া শুরু করতে মস্তিস্ক ও শরীরের অন্যান্য অংশে সংকেত পাঠায়। এছাড়াও এটি হাইপোথ্যালামাসসহ (Hypothalamus) মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশে সংকেত পাঠায় এবং এর ফলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যাবার মতো শারীরিক পরিবর্তন ঘটে। আমাদের শরীরের ভেতরে এতসব পরিবর্তন ঘটে যাওয়ার ফলে আমরা ভয় পেতে শুরু করি।  

ব্রেইন ইমেজিং গবেষনায় দেখা গেছে যে অ্যামিগডালা শুধু বাস্তব বিপদের প্রতিক্রিয়ায় শুধু নয়, বরং তা কল্পিত বা প্রত্যাশিত বিপদের চিন্তাতেও সক্রিয় হতে পারে। অন্যভাবে বলা যায়, বাস্তব কোন হুমকি ছাড়াই আমাদের মস্তিস্ক তীব্র ভয়ের প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। এ কারনেই নিরাপদ পরিবেশেও মানুষ ভয় পেতে পারে। 

হিপোক্যাম্পাস (Hippocampus), মস্তিস্কের যে অংশ স্মৃতি তৈরির সাথে জড়িত থাকে, তা ভয় প্রক্রিয়াকরনে অতিরিক্ত ভূমিকা রাখে। গবেষনায় দেখা গেছে, এটি একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট, স্থান বা সংকেতকে আগেকার ভীতিকর অভিজ্ঞতার সাথে জোড়া লাগিয়ে দেয়। এই স্মৃতির সংযোগ বোঝায় কেন কিছু ভয় আমাদের  মনে দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকে।  

এই ধরনের সংযোগ মানুষের মনে কোন নির্দিষ্ট বস্তু বা পরিস্থিতির প্রতি তীব্র, অযৌক্তিক ভয় বা ফোবিয়ার জন্ম দিতে পারে। উদাহরন হিসেবে বলা যায়, কাউকে যদি একবার কুকুর আক্রমন করে, তাহলে তার মনে কুকুরকে ঘিরে একটি স্থায়ী ভয়ের অনুভূতি কাজ করতে পারে, এমনকি সে সম্পুর্ন নিরাপদ পরিবেশে কুকুরের ছবি, ভিডিও বা পুতুল দেখলেও ভয় পেতে পারে। এই ভয় তার মনে গভীরভাবে গেঁথে যেতে পারে এবং চিকিৎসা ছাড়া তা কাটিয়ে ওঠা কঠিন হতে পারে। 

মানুষের মনে ভয়ের বিকাশলাভ 

ভয়ের অনুভূতি মানুষের মনে শৈশবকাল থেকেই বিকাশ লাভ করতে শুরু করে এবং এটি তাদের জৈবিক প্রবণতা ও পরিবেশগত অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। শিশুদের কাছে জোরে শব্দ করলে বা তাদেরকে নিয়ে হঠাৎ করে নড়াচাড়া করলে তারা ভয়ে কেঁদে ওঠে। এর ফলে বোঝা যায় যে কিছু সম্ভাব্য বিপদজ্জনক ঘটনার প্রতি তারা জন্মগতভাবেই সংবেদনশীল হয়ে থাকে। 

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুরা পর্যবেক্ষন এবং ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তাদের জন্য কী বিপদজ্জনক তা শিখতে শুরু করে। বাস্তব জীবনে তারা যন্ত্রনাদায়ক বা কষ্টকর অভিজ্ঞতার স্বাদ পাবার পরে তারা ভবিষ্যতে সেরকম ক্ষতিকর পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে। এই শেখার মাধ্যমে তারা কী কী জিনিসকে ভয় পাওয়া উচিৎ, তা বুঝতে শেখে। 

পিতামাতা, শিক্ষক এবং সহপাঠীরা শিশুদের মনে ভয়ের প্রতিক্রিয়া গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। উদাহরন স্বরূপ, যদি কোন শিশু তার পিতামাতাকে মাকড়সা দেখে ভয় পেতে দেখে, তাহলে সেও মাকড়সাকে ভয় পেতে শুরু করতে পারে। একে সোশ্যাল লার্নিং (Social learning) বলা হয়, যা মানুষের মধ্যে ভয়ের বিকাশ ঘটানোর একটি শক্তিশালী প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করে থাকে।

ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিং (Classical conditioning) এর মাধ্যমে আরও একটি উপায়ে মানুষের মনে ভয় বিকাশ লাভ করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় একটি সাধারণ, নিরপেক্ষ ধারণা বা জিনিসের সথে একটি ভীতিকর ঘটনার সংযোগ ঘটে। উদাহরণ স্বরূপ, যদি কোন শিশুকে কুকুর কামড়ায়, তাহলে সে সব কুকুরকেই ভয় পেতে শুরু করতে পারে।

অভিজ্ঞতার ফলে শেখা ভয়গুলো অনেক সময় মূল ঘটনার অনেক বছর পরে পর্যন্ত টিকে থাকে। এমনকি ব্যক্তির জন্য যদি আর কোন হুমকি নাও থেকে থাকে, তবুও তার মনে আজীবন সে ভয় বজায় থাকতে পারে। এসব ব্যাপার থেকে আমরা বুঝতে পারি যে শৈশবকালের অভিজ্ঞতা এবং সামাজিক সংকেতগুলো মানুষের আবেগীয় বিকাশে কতটা গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।  
 
ভয়ের-মনস্তত্ত্ব

 
 

ভয়ের প্রকারভেদ 

মনোবিজ্ঞানীরা ভয়কে কয়েক ভাগে ভাগ করেছেন। এগুলো হলঃ
  •  তীব্র ভয় (Acute Fear)ঃ তীব্র ভয় হল বর্তমানে কোন হুমকির কারনে সৃষ্ট হওয়া একটি অস্থায়ী এবং তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া। এটি হঠাৎ কোন শব্দ শোনা বা বন্য পশুর মুখোমুখি হওয়ার মত ঘটনা থেকে উদ্ভূত হতে পারে। এই ধরনের ভয় শরীরকে বিপদকে মোকাবেলা করা অথবা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাবার জন্য (fight or flight response) প্রস্তুত করে। 
  • দীর্ঘস্থায়ী ভয় (Chronic Fear) ঃ দীর্ঘস্থায়ী ভয় হল ব্যাক্তির মনে অনেক দিন থেকে চলে আসা এক ধরনের দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগ এবং দুশ্চিন্তা, যার নির্দিষ্ট কোনো উৎস নাও থাকতে পারে। এটি অতীতের শারীরিক ও মানসিক আঘাত, চলমান চাপ বা জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে থেকে উদ্ভূত হতে পারে। সময়ের সাথে সাথে এই ভয় আমাদের স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। 
  • অযৌক্তিক ভয় (Phobias)ঃ অযৌক্তিক ভয় বা ফোবিয়া হলো কোন নির্দিষ্ট বস্তু বা পরিস্থিতি সম্পর্কে তীব্র ও অযৌক্তিক ভয়। `উচ্চতা, উড়োজাহাজে চড়া, মাকড়সা, টিকটিকি বা আরশোলা দেখে ভয় পাওয়া এর সাধারন কিছু উদাহরন। এরকম ভয় দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে এবং সমাজের অন্যান্য মানুষদের কাছে তাদের আচরনকে অদ্ভুত মনে হতে পারে।  
  • সামাজিক ভয় (Social Fear)ঃ সামাজিক ভয় বলতে ব্যাক্তির এমন পরিস্থিতিকে ভয় পাওয়া বোঝায় যেখানে সে অন্যদের দ্বারা বিচার, লজ্জা বা প্রত্যাখিত হতে পারে। চরম অবস্থায় এটি একধরনের আচরণগত ও মানসিক সমস্যা রূপে দেখা দিতে পারে; এতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়ই লোকজনের সাথে মেলামেশা বা সবার সামনে কথা বলা এড়িয়ে চলেন। এরকম ভয় ব্যক্তির সামাজিক সম্পর্কে, শিক্ষা ও পেশাগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। 
  • অস্তিত্বগত ভয় (Existential Fear): অস্তিত্বগত ভয় হলো মানুষের জীবনের অর্থ, উদ্দেশ্য, মৃত্যু এবং অজানার সাথে জড়িয়ে থাকা এক ধরনের গভীর এবং বিমূর্ত ধরনের ভয়। জীবনে বড় কোন পরিবর্তন বা সংকটের সময় আমাদের মনে এই ধরনের ভয় দেখা দিতে পারে। এই ধরনের ভয় ব্যাক্তির মনে গভীর চিন্তা এবং মানসিক অস্থিরতার সৃষ্টি করতে পারে। 
 

ভয় যেভাবে মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করে  

ভয় মানুষের আচরণকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে। স্বল্পমেয়াদে, এটি প্রায়ই দ্রুত ও মানানসই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যা আমাদের বিপদ এড়াতে সাহায্য করে। এসব প্রতিক্রিয়াগুলো প্রয়োজনে আমাদেরকে তাৎক্ষণিক ভাবে সাড়া দিতে বাধ্য করে আমাদের জীবন বাঁচিয়েও দিতে পারে। 

তবে দীর্ঘমেয়াদে ভয় আমাদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। অতিরিক্ত ভয় পাওয়া বা অযৌক্তিক ভয় মানুষের মনে দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ ও এড়িয়ে চলার প্রবণতা তৈরি করতে পারে। এর ফলে তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপ ব্যাহত হতে পারে এবং জীবনের মান কমে যেতে পারে। 
 
ভয়ের একটি সাধারন প্রতিক্রিয়া হলো এড়িয়ে চলা। উদাহরনস্বরূপ, কেউ যদি মানুষের সাথে মিশতে ভয় পায়, তাহলে সে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাহিরে যাওয়া এড়িয়ে চলতে পারে। এর ফলে সে স্বল্পমেয়াদে স্বস্তি পেলেও এটি দীর্ঘমেয়াদে ভয়কে আরও দৃঢ় করে তোলে এবং তাকে তার জীবনকে উপভোগ করতে দেয় না। 

ভয় মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহনেও শক্তিশালী প্রভাব ফেলে। এটি ব্যাক্তিদের সম্ভাব্য ঝুঁকিকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সিরিয়াসভাবে নিতে এবং নিজেদের সামর্থ্য নিয়ে সন্দেহ করতে বাধ্য করে। এর ফলে মানুষ চাপে পড়ে অতি সতর্ক বা অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
 
ব্যবসা বা রাজনীতির মতো উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে ভয় মানুষের বিচারবুদ্ধি বিকৃত করতে পারে। নেতারা কখনও কখনও রাজনীতিতে তাদের সম্ভাব্য হুমকি এড়াতে প্রতিরক্ষামূলক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। এই ধরনের ভয় চালিত সিদ্ধান্তে সুযোগ হাতছাড়া হতে পারে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফলের সৃষ্টি হতে পারে।   

ভয় যেভাবে আমাদের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে 

ভয় আমাদের চিন্তাভাবনার উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এটি সম্ভাব্য বিপদের দিকে আমাদের মনোযোগকে, বিশেষ করে যে সকল হুমকিকে আমরা সামনাসামনি দেখতে পাই, তার দিকেই ফোকাস করে। বাস্তব বিপদের ক্ষেত্রে এই প্রতিক্রিয়া সহায়ক হলেও, আধুনিক পরিবেশে এটি তেমন কার্যকর নাও হতে পারে। 

বর্তমান সময়ের অনেক হুমকিই আমাদের জন্য শারীরিক নয়, বরং বিমূর্ত বা প্রতীকী হয়ে থাকে। এই ধরনের ভয়ে মানুষের উপলব্ধি ও সিদ্ধান্ত গ্রহন করার ক্ষমতা বিকৃত হতে পারে। এর ফলে তাদের মনে উদ্বেগ ও এড়িয়ে চলার আচরন দেখা দিতে পারে যা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে বাধা সৃষ্টী করে। 

মানুষের চিন্তার উপর ভয়ের প্রভাবের একটি ভালো উদাহরন হলো ভয়াবহ চিন্তভাবনা (Catastrophic thinking)। এটি এমন একটি মানসিক প্রবনতা যেখানে মানুষ, তার কোন বিপদ না থাকলেও, সারাক্ষন তার সবচেয়ে খারাপ পরিনতির কথা কল্পনা করে অযথা দুশ্চিন্তা বাড়াতে থাকে। এরকম চিন্তাভাবনা ব্যাক্তির মানসিক চাপ বাড়ায় এবং যৌক্তিকভাবে সমস্যার সমধানে বাধা সৃষ্টি করে। 

ভয় মানসিক পক্ষপাত (Cognitive Bias) সৃষ্টি করতেও সাহায্য করে থাকে। অ্যাভেইল্যাবিলিটি হিউরিস্টিক (Availability heuristic) হচ্ছে এমন এক ধরনের মানসিক পক্ষপাত যেখানে মানুষ সম্প্রতি দেখা বা শোনা ঘটনাকে ভিত্তি করে তার জীবনের ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারন করে। গনমাধ্যমে অপরাধ বা দুর্যোগ নিয়ে অতিরঞ্জিত রিপোর্ট এই পক্ষপাতকে আরও তীব্র করে তোলে; যার ফলে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যত স্বাভাবিকই হোক না কেন, মানুষের কাছে মনে হয় পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। 
সবশেষে, ভয় স্মৃতি ও শেখার ক্ষমতাকেও ব্যাহত করতে পারে। অতিরিক্ত ভয় পেলে, আমাদের মস্তিস্কের তথ্য প্রক্রিয়াকরন ও মনে রাখার ক্ষমতা হ্রাস পায়। এর ফলে শিক্ষা, অফিস এবং সামাজিক পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। 

ভয়ের বিকাশে সমাজ ও সংস্কৃতির ভূমিকা 

মানুষের মনে ভয়ের অনুভূতি এমনি এমনি শাখা প্রশাখা বিস্তার করে ছড়িয়ে পড়ে না। এটি সাংস্কৃতিক নিয়ম ও সামাজিক কাঠামোর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। এই প্রভাবগুলো মানুষ কী ভয় পায় এবং সেই ভয় সে কীভাবে প্রকাশ করে তা নির্ধারন করে দেয়। 

কিছু সংস্কৃতিতে ভয় প্রকাশ করাকে দুর্বলতার চিহ্ন হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। আবার অন্য সংস্কৃতিতে একে একটি স্বাভাবিক বা কাঙ্ক্ষিত আবেগগত প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ভয় নিয়ে এমন ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি মানুষ কিভাবে ভয়কে মোকাবেলা করবে তার উপর প্রভাব ফেলে। 

সমাজও কখনো কখনো ভয় সৃষ্টি করে বা ভয়কে কাজে লাগায়। রাজনৈতিক দল, বহুজাতিক কর্পোরেশান এবং গনমাধ্যম ভয় ব্যবহার করে মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা বা জনমতকে প্রভাবিত করতে চায়। উদাহরনস্বরুপ, মশার কয়েল তৈরি করে এমন কোম্পানিগুলো মানুষের মশাবাহিত রোগের ভয়কে কাজে লাগিয়ে তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করে।  

রাজনীতিতেও ভয়কে একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রাজনীতিবিদরা বাহিরের দেশের চক্রান্ত, অর্থনৈতিক পতন বা সামাজিক পরিবর্তনের ভয় দেখিয়ে জনগনের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন। এই ধরনের কৌশল সমাজে বিভাজন ও অবিশ্বাসের সৃষ্টি করে। 

কোভিড-১৯ মহামারী ভয়ের সামাজিক প্রভাবের একটি সাম্প্রতিক উদাহরন। এই ভয় যেমন মানুষকে মাস্ক পরা ও সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে উৎসাহিত করেছে, তেমনিভাবে এটি তাদেরকে আতঙ্কিত কেনাকাটা, বিদেশি-বিদ্বেষ ও ভুল তথ্য ছড়ানোরও কারন হয়েছে। এর ফলে মহামারির সময়ে মানুষের উদ্বেগ ও বিভ্রান্তি আরও বেড়ে গিয়েছিল। 
 

ভয় সামলানোর কিছু উপায়  

ভয় যেহেতু আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই একে সামলানোর জন্য আমাদের সুস্থ উপায়গুলো গড়ে তুলতে হবে। ভয়কে সামলানোর জন্য কিছু সাধারন কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
  • কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT)ঃ অতিরিক্ত উদ্বেগ এবং ফোবিয়ার চিকিৎসায় CBT একটি অন্যতম কার্যকর পদ্ধতি। এটি ভয়ের পেছনে থাকা অযৌক্তিক চিন্তাগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোকে পদ্ধতিগতভাবে চ্যালেঞ্জ করে। এই থেরাপিতে ব্যাক্তিকে নিয়ন্ত্রিত ও ধাপে ধাপে ভীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ানোর মাধ্যমে তার ভয় কাটানো হয়। 
  • মননশীলতা ও বিশ্রাম কৌশলঃ মেডিটেশন, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস এবং প্রগ্রেসিভ মাসল রিল্যাক্সেশন এর মতো কৌশল ভয়ের শারীরিক লক্ষন কমাতে সাহায্য করে। এই পদ্ধতিগুলো আমাদেরকে মানসিক প্রশান্তি এবং আবেগ নিয়ন্ত্রনে সহায়তা করে থাকে। এগুলো নিয়মিত চর্চা করলে উদ্বেগ হ্রাস পায় এবং মনে শান্তি আসে। 
  • শিক্ষা ও তথ্যঃ ভয়ের উৎস এবং প্রকৃতি সম্পর্কে জানা এর তীব্রতা অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। যেমন, কেউ যদি টিকটিকি দেখে ভয় পায় আর যে যদি পড়াশোনা করে জানতে পারে যে টিকটিকি আসলে একটা নিরীহ প্রাণী, এটি মানুষের কোন ক্ষতি করে না; তাহলে টিকটিকি সম্পর্কে তার আযৌক্তিক ভয় কমে যেতে পারে। ভয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করলে মানুষ তার উপর নিয়ন্ত্রণ অনুভব করে। 
  • সামাজিক সহায়তাঃ বিশ্বস্ত্য বন্ধু, পরিবার বা থেরাপিস্টের সাথে ভয়ের কথা শেয়ার করা মানুষকে মানসিকভাবে শান্তিতে থাকতে দেয়। এর ফলে সে অনুভব করে যে সে একা নয়, বরং অন্যরাও তার অনুভুতিগুলোকে গুরুত্ব দেয়। পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে এরকম সমর্থন পাওয়া ব্যাক্তিকে তার ভয়ের মুখোমুখি হতে অনুপ্রানিত করে এবং ভয়কে এড়িয়ে যাবার প্রবণতা কমায়। 
  • এক্সপোজার থেরাপিঃ ধাপে ধাপে ভীতিকর বস্তুর মুখোমুখি হওয়া এর প্রতি সংবেদনশীলতা এবং এড়িয়ে যাওয়ার আচরন কমাতে সাহায্য করে। এই পদ্ধতিটি সাধারনত একটি কাঠামোবদ্ধ ধাপে পরিচালিত হয় যাতে রোগীর মনে আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে। এটি চরম ফোবিয়া এবং দীর্ঘদিনের ভয়ের চিকিৎসায় বিশেষভাবে কার্যকর। 
 
 
ভয়ের-মনস্তত্ত্ব


ভয়ের ইতিবাচক দিকগুলো 

যদিও ভয়কে প্রায়ই নেতিবাচকভাবে দেখা হয়ে থাকে, তারপরেও এর কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। ভয় আমাদেরকে বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য একটি সুরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে। এটি আমাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে প্রুস্তুতি নিতে বা কাজ করতে অনুপ্রানিত করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই ভয় আমাদেরকে চাপের মুখে প্রতিক্রিয়া জানাতে শিখিয়ে মানসিক দৃঢ়তা গড়ে তোলে।  

যথাযথভাবে পরিচালিত হলে, ভয় ব্যক্তিগত বিকাশের একটি প্রেরণার উৎস হতে পারে। ভয়কে মোকাবেলা করে তা সফলভাবে অতিক্রম করলে আত্মবিশ্বাস ও আত্মজ্ঞান বৃদ্ধি পায়। এরকম প্রতিটি বিজয় আমাদের নিজেদের ক্ষমতার উপর বিশ্বাস বাড়ায় এবং আমাদের মনে সাফল্যের অনুভূতি এনে দেয়।

ভয় শিল্প, সাহিত্য এবং বিনোদনের জগতেও একটি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। হরর সিনেমা, সাসপেন্স উপন্যাস এবং থ্রিলারগুলি নিয়ন্ত্রিত ও নিরাপদ উপায়ে আমাদের মনে ভয়ের প্রতিক্রিয়া জাগিয়ে তোলে। এই ধরনের অভিজ্ঞতা আমাদেরকে বাস্তব বিপদের মুখোমুখি না হয়েও তীব্র আবেগ এবং এর সাথে সম্পর্কিত বিষয় গুলো চেখে দেখার সুযোগ করে দেয়।

ব্যাক্তিগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভয় প্রায়ই পরিচিত ও অজানার মাঝের সীমারেখা নির্দেশ করে। জীবনে এগিয়ে যেতে হলে আমাদেরকে প্রায়ই স্বাচ্ছন্দ্যের অঞ্চল (Comfort Zone) থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। জীবনে প্রথমবারের মত বাড়ীর বাহিরে বসবাস করা, নতুন কোন ব্যবসা শুরু করা, অথবা ক্ষতিকর সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটানো - প্রায় সব জায়গাতেই উন্নতির জন্য ভয়ের মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন।

অবশেষে, ভয় থেকে পালিয়ে নয় বরং এর সাথে বসবাস করতে শিখে নেওয়াই মানব অভিজ্ঞতার একটি গুরুত্বপূর্ন অংশ। যখন আমরা ভয়কে জীবনের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে মেনে নিই, তখন এটি একটি শক্তিশালী রুপান্তরের শক্তিতে পরিণত হতে পারে। 

শেষ কথা 

এই আর্টিকেল থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে ভয়ের মনস্তত্ত্ব মানুষের জৈবিক প্রক্রিয়া, চিন্তাভাবনা, আচরন, এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবের একটি জটিল সমীকরণকে প্রকাশ করে। যদিও ভয় আমাদের জীবনের একটি স্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এটি তখনই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় যখন তা আমাদের চিন্তা ও আচরণকে নিয়ন্ত্রন করতে শুরু করে। 

ভয় কীভাবে গড়ে ওঠে, আমাদের উপর তা কি প্রভাব ফেলে এবং কীভাবে তা সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায় - এসব বোঝার মাধ্যমে আমরা আরও স্বাধীন ও সচেতনভাবে জীবনযাপন করতে পারি। ভয়কে শত্রু না ভেবে যদি আমরা একে দিকনির্দেশক হিসেবে দেখি, তবে এটি আমাদেরকে শুধু ঝুঁকি নয় বরং জীবনের উন্নতির পথও দেখাতে পারে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url