রহস্যময়ভাবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া কিছু বিখ্যাত জাহাজের কথা
এই পৃথিবীর অসীম ও অনিশ্চিত মহাসাগরগুলো যুগ যুগ ধরে মানুষের রোমাঞ্চ, আবিস্কার
এবং রহস্যের কাহিনীগুলোর পটভূমি হয়ে এসেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষনীয় সামুদ্রিক
গল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে সেই জাহাজগুলোর কথা, যেগুলো কোন স্পষ্ট ব্যাখ্যা ছাড়াই
অদৃশ্য হয়ে গেছে।
আধুনিক নেভিগেশন ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতির পরেও কিছু নিখোঁজের ঘটনা
আজও রহস্যই থেকে গেছে, যা আমাদের কল্পনা ও কৌতূহলকে উসকে দেয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়
থেকে শুরু করে অতিপ্রাকৃত শক্তি পর্যন্ত, জাহাজগুলোর এই নিখোঁজ হয়ে যাবার
ঘটনাগুলোর পেছনে থাকা নানা তত্ত্ব এখনও বিশেষজ্ঞ ও আগ্রহী অনুসন্ধানকারীদের মুগ্ধ
করে রেখেছে।
সূচিপত্রঃ রহস্যময়ভাবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া কিছু বিখ্যাত জাহাজের কথা
এস এস ওরাং মেডান
এস এস ওরাং মেডানকে (SS Ourang Medan) আজ পর্যন্ত সবচেয়ে ভীতিকর সামুদ্রিক রহস্যগুলোর মধ্যে অন্যতম ধরা হয়ে থাকে।
ধারনা করা হয়, ১৯৪০ এর দশকের শেষ দিকে এই ঘটনার সুত্রপাত ঘটে, যা আজ পর্যন্ত
ষড়যন্ত্র তত্ত্ববিদ, সামুদ্রিক ইতিহাসবিদ এবং সংশয়বাদীদের মনে কৌতুহল জাগিয়ে
এসেছে। এই গল্প অনুসারে, ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে
মালাক্কা প্রণালীতে
চলাচল করা জাহাজগুলো হঠাৎ করে ঐ এলাকায় ভেসে থাকা এক জাহাজ থেকে অদ্ভুত বিপদ
সংকেত পেতে শুরু করে।
এই বার্তাটি একই সাথে রহস্যময় এবং ভীতিকর ছিল, এতে বলা হয়েছিল, "ক্যাপ্টেনসহ সকল
অফিসার মরে গেছে...তারা চার্টরুম এবং ব্রিজে মরে পরে আছে....খুব সম্ভবত জাহাজের
সবাই মরে গেছে!" কয়েকটি অস্পষ্ট বার্তার পর, "আমিও মরে যাচ্ছি!", এই বলে রেডিও
বার্তাটি শেষ হয়। এরপর সম্পূর্ণ নীরবতা নেমে আসে; এর ফলে আশেপাশের জাহাজগুলো সাথে
সাথে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে দেয়।
নিকটবর্তী একটি আমেরিকান জাহাজ, সিলভার স্টার, এই সংকেতের জবাব দেয় এবং
ভেসে থাকা ওরাং মেডানকে খুঁজে পায়। জাহাজে উঠার পর উদ্ধারকারী দল একটি
ভয়ংকর ও রহস্যময় দৃশ্যের মুখোমুখি হয়। তারা জাহাজের সমস্ত নাবিকদের মৃত অবস্থায়
দেখতে পায়, তাদের দেহ জাহাজের ডেক বা উপরের অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল, তাদের চোখ
খোলা ছিল এবং চেহারায় স্পষ্ট আতংকের ছাপ দেখা যাচ্ছিল।
পুরো ঘটনাটিকে যে ব্যাপারটি আরও রহস্যময় করে তোলে তা হল, মৃতদেহগুলিতে কোনো
দৃশ্যমান আঘাতের চিহ্ন ছিল না। মনে হচ্ছিল কোনো অদৃশ্য শক্তি একসাথে সবাইকে
নিঃশেষ করে দিয়েছে। এমনকি জাহাজের একমাত্র কুকুরটিকেও মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়,
সেটি দাঁত বের করে কোন এক অদৃশ্য শত্রুর দিকে চেয়ে ছিল।
অধিকতর তদন্ত করার জন্য জাহাজটিকে উদ্ধার করে বন্দরে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করা
হচ্ছিল ঠিক তখনই জাহাজের নিচের অংশে আগুন ধরে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই
ওরাং মেডান ব্যাপক বিস্ফোরণে ধ্বংশ হয়ে সমুদ্রে তলিয়ে যায়, যার ফলে আর কোন
তদন্ত করা সম্ভব হয়নি। বিস্ফোরণের প্রকৃত কারন আজও অজানাই থেকে গেছে।
এই ঘটনা ব্যাখ্যা করার জন্য অনেকে অনেক তত্ত্ব বের করেছেন। কারও মতে, কার্বন
মনো-অক্সাইড বিষক্রিয়া অথবা রাসায়নিক গ্যাস লিক হবার কারনে ঐ জাহাজের নাবিকেরা
ভূল দেখা, ভূল শোনা, উল্টা পাল্টা আচরন এবং সবশেষে মৃত্যু বরন করেন। আবার অনেকে
মনে করেন, জাহাজটি সম্ভবত বিপজ্জনক বা গোপন সামরিক রাসায়নিক বহন করছিল।
তবে ওরাং মেডান নামে আদৌ কোন জাহাজ বাস্তবে ছিল কিনা তা নিয়ে অনেকেই
সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কোন নির্ভরযোগ্য সামুদ্রিক রেকর্ডে এই জাহাজের
অস্তিত্বের প্রমান পাওয়া যায়নি, এবং বিভিন্ন সুত্র অনুসারে ঘটনার বিবরনও ভিন্ন
হয়ে থাকে। এরকম অস্পষ্টতার জন্য অনেকে এটিকে কল্পকাহিনি বা অতিরঞ্জিত কিংবদন্তি
বলে মনে করেন।
সত্য, মিথ বা দুয়ের সংমিশ্রণ, যাই হোক না কেন, ওরাং মেডান এর কাহিনি
এখনও যারা ইতিহাসের রহস্য নিয়ে আগ্রহী তাদের মনে কৌতূহল জাগায়। এটি আমাদেরকে
মনে করিয়ে দেয় যে, এই পৃথিবীর অনেক কিছুই আমাদের জানতে বাকি রয়েছে। যতদিন না
নিশ্চিত প্রমান পাওয়া যায়, ততদিন ঐ জাহাজ ও তার রহস্যময় নাবিকেরা ইতিহাস এবং
সমুদ্রের গহ্বরে হারিয়ে থাকবে।
এস এস ওয়ারাটাহ
এস এস ওয়ারাটাহ (SS Waratah) একটি যাত্রী ও পণ্যবাহী জাহাজ ছিল, যাকে ১৯০৮ সালে ব্লু অ্যাঙ্কর লাইন (Blue Anchor Line) জাহাজ কোম্পানির জন্য নির্মান করা হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় যাত্রাবিরতি করে,
এটি ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে যাতায়াত করত। জাহাজটি বড় ও বিলাসবহুল ছিল, যার
কারনে একে অনেক সময় টাইটানিক এর সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে, যদিও এটি অনেক
আগে থেকেই যাত্রা শুরু করে।
১৯০৯ সালের জুলাই মাসে ওয়ারাটাহ দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান বন্দর থেকে কেপ টাউন
যাওয়ার পথে ছিল। এতে ২০০-র বেশি যাত্রী ও নাবিক ছিলেন, যাদের মধ্যে পরিবার সহ
সাধারন লোকজন ও উল্লেখযোগ্য ব্যবসায়ীরাও ছিলেন। ২৬ জুলাই ডারবান ত্যাগ করার পরে,
এটি কয়েক দিনের মধ্যেই কেপ টাউনে পৌঁছানোর কথা ছিল।
জাহাজটি ডারবান ছাড়ার পর আরেকটি জাহাজ ক্ল্যান ম্যাকইনটাইর (Clan
Macintyre) সেটিকে একবার দেখতে পায়। তাদের মতে, ওয়ারাটাহ উপকূল
বরাবর স্থির গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। এর কিছুদিন পরে এটি হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে যায়,
এবং এই জাহাজের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকেদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়।
জাহাজটি থেকে কোন যোগাযোগ না পাওয়ার খুব অল্পদিনের মধ্যেই অনুসন্ধান ও উদ্ধার
কার্যক্রম শুরু হয় এবং এতে একাধিক জাহাজ ও বিমান অংশগ্রহন করে। হাজার হাজার মাইল
সমুদ্রজুড়ে তল্লাশি চালানো হলেও জাহাজের কোন ধ্বংসাবশেষ, দেহ বা অন্যান্য প্রমান
খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই নিখোঁজ হওয়া ঘটনাটি জনসাধারন এবং নৌ কর্তৃপক্ষকে স্তম্ভিত
করে তোলে।
এই জাহাজটি হারিয়ে যাবার পরে এর হারানোর কারণ হিসেবে অনেকগুলো তত্ত্ব বের হয়ে
আসে। কেউ কেউ মনে করেন, জাহাজটি হঠাৎ কোন ঝড়ের কবলে পরে উল্টে গিয়েছিল। আবার
অনেকের মতে, জাহাজটির কাঠামোগত ত্রুটি ছিল, যার ফলে এটি ভারসাম্য হারিয়ে ঝড়ে ডুবে
যেতে পারে।
এর আগেও পূর্ববর্তী যাত্রীদের মধ্যে অনেকে জাহাজটির স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ
প্রকাশ করেছিলেন। কেউ কেউ আবার ডারবান বন্দরেই নেমে যান, তারা আর জাহাজে উঠেননি;
জাহাজটি সমুদ্রের ঢেউয়ে ভয়ানকভাবে দুলছিল বলে তারা সাংবাদিক ও তদন্তকারী
কর্মকর্তাদের জানান। পরে জাহাজটি নিখোঁজ হয়ে যাবার পরে সেই সতর্কতাগুলো আরও করুন
বাস্তবতা লাভ করে।
ওযারাটাহ এর নিখোঁজ রহস্য আজও উদঘাটিত হয়নি, এবং এর ডুবে যাবার কোন
নিশ্চিত প্রমান মেলেনি। একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বহু অভিসন্ধান অভিযান চালানো
হয়েছে, কিন্তু কেউই জাহাজটির ধ্বংশাবশেষ খুঁজে পায়নি। এটি সামুদ্রিক ইতিহাসে
অন্যতম রহস্যময় নিখোঁজের ঘটনা হিসেবে রয়ে গিয়েছে।
আকার, যাত্রীসংখ্যা ও মর্মান্তিক পরিনতির কারনে ওয়ারাটাহ কে প্রায়ই
"অস্ট্রেলিয়ার টাইটানিক" বলা হয়ে থাকে। যদিও এই জাহাজ টাইটানিক এর
মতো বিশ্ববিখ্যাত নয়, তবুও এর কাহিনি একইভাবে ভীতিকর ও মর্মান্তিক। আজও এটি
সমুদ্রের শক্তি ও রহস্যের একটি নিঃশব্দ স্মারক হয়ে রয়ে গিয়েছে।
ইউএসএস সাইক্লোপস
ইউএসএস সাইক্লোপস (USS Cyclops) ছিল মার্কিন নৌবাহিনীর একটি বিশালাকার কোলিয়ার (এক ধরনের মাল বহনকারি জাহাজ),
যাকে প্রধানত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান জাহাজে কয়লা ও সরবরাহ পৌছে দেবার
কাজে ব্যবহার করা হতো। ১৯১০ সালে নির্মিত এই জাহাজটি সে সময়ের অন্যতম বৃহৎ
ও সক্ষম কার্গোবাহী জাহাজ ছিল। এর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি আমেরিকান নৌ- ইতিহাসের
সবচেয়ে রহস্যময় অধ্যায়গুলোর একটি।
১৯১৮ সালের মার্চ মাসে ৩০০-র বেশি মানুষ নিয়ে সাইক্লোপস ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের
বার্বাডোস দ্বীপ থেকে আমেরিকার বাল্টিমোর শহরের দিকে রওনা দিচ্ছিল। জাহাজটি
ম্যাঙ্গানিজ আকরিক বহন করছিল, যা স্টিল উৎপাদনে ব্যবহৃত একটি ভারী খনিজ পদার্থ। ৪
মার্চ বার্বাডোজ ত্যাগ করার পরে এই জাহাজটিকে আর কখনো দেখা যায়নি।
ভ্রমনের সময় জাহাজটি কোন বিপদ সংকেত পাঠায়নি। যদিও এতে যোগাযোগের যন্ত্রপাতি ছিল,
তারপরেও এই জাহাজ থেকে কোন রেডিও বার্তা পাওয়া যায়নি। এই হঠাৎ নীরবতার কারনে এই
জাহাজ খুঁজে বের করার জন্য ব্যাপক অনুসন্ধানের সূচনা হয়।
মার্কিন নৌবাহিনী জাহাজটিকে খুঁজে বের করার জন্য ব্যাপক অনুসন্ধান অভিযান
পরিচালনা করে; এর অনুসন্ধানে তারা আটলান্টিক মহাসাগরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল
তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখে। কিন্তু কোথাও কোনো ধ্বংসাবশেষ, সমুদ্রের পানিতে তেল
ছড়ানো দাগ বা নাবিকদের লাশ মেলেনি। প্রমানের সম্পূর্ণ অভাব ঘটনাটিকে আরও রহস্যময়
ও ভীতিকর করে তোলে।
সাইক্লোপস এর নিখোঁজ হওয়াকে প্রায়ই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের (পশ্চিম আটলান্টিকে
অবস্থিত একটি অঞ্চল যেখানে বহু জাহাজ ও বিমান রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছে বলে দাবী
করা হয়) সাথে জড়িয়ে ফেলা হয়। এই সংযোগ অনেকাংশে অনুমাননির্ভর হলেও তা যুগ
যুগ ধরে মানুষের কল্পনাকে উসকে দিয়ে আসছে। জাহাজটির সর্বশেষ অবস্থান বারমুডা
ট্রায়াঙ্গেলের সীমানার মধ্যেই ছিল বলে মনে করা হয়।
জাহাজটি নিখোঁজ হবার সম্ভাব্য কারন হিসেবে বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি তত্ত্ব উপস্থাপন
করেছেন। অতিরিক্ত ভারের কারনে যান্ত্রিক ত্রুটি, কাঠামোগত দুর্বলতা অথবা আকস্মিক
ঝড় - সবই আলোচিত হয়েছে। তবুও কোন তত্ত্বই প্রমানসহ নিশ্চিত করা যায়নি।
এই ঘটনা মার্কিন নৌবাহিনীর ইতিহাসে যুদ্ধবিহীন সময়ে সবচেয়ে বড় প্রানহানির
ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে ৩০৬ জন নাবিক একসাথে নিখোঁজ হন এবং তাদের সবাইকে
মৃত বলে ধরে নেওয়া হয়। আজও ইউএসএস সাইক্লোপস এর পরিনতি অজানা রয়ে গেছে। আধুনিক
প্রযুক্তি ও বহু অনুসন্ধান অভিযান সত্ত্বেও জাহাজটির ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া
যায়নি। এই জাহাজের রীতিমতো হাওয়ায় মিলিয়ে যাবার রহস্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের
কিংবদন্তি ও সমুদ্রে বিপদের কাহিনিকে আরও গভীর করে তোলে।
এম ভি জয়িতা
বাণিজ্যিক জাহাজ, এম ভি জয়িতাকে (MV Joyita), ১৯৫৫ সালে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে রহস্যজনকভাবে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া
যায়। জাহাজটি আংশিকভাবে ডুবে থাকলেও এর কর্ক আবৃত কাঠামোর কারনে এটি সাগরে ভেসে
ছিল। আশ্চর্যের বিষয় হল, জাহাজটির ২৫ জন যাত্রী ও নাবিকদের কেউও সেখানে ছিল
না।
জাহাজটি খুঁজে পাওয়ার পর দেখা যায় যে জাহাজের রেডিও আন্তর্জাতিক বিপদ সংকেত
ফ্রিকোয়েন্সিতে টিউন করা ছিলো। এর ফলে বোঝা যায় জাহাজের নাবিকেরা সাহায্য চেয়ে
বিপদ সংকেত পাঠানোর চেষ্টা করেছিল। তবে আশেপাশের কোনো স্টেশন সেই সংকেত
পায়নি।
পরবর্তী তদন্তে দেখা যায়, জাহাজটির রক্ষনাবেক্ষন অত্যন্ত বাজে অবস্থায় ছিল।
জাহাজের বিল্জ পাম্পকে, যা জাহাজের সবচেয়ে নিচের অংশে জমা হওয়া পানি পাম্প করে
বের করে দেয়, অকেজো অবস্থায় পাওয়া যায়। এর ফলে ধীরে ধীরে পানি ঢুকে জাহাজটি
আংশিকভাবে ডুবে যায়।
জাহাজে কিছু মালপত্র ও রসদ, যেমন চিকিৎসার সরঞ্জাম ও খাবার নিখোঁজ ছিল। এছাড়াও
জাহাজটিতে লাইফবোট ও রাফটও পাওয়া যায়নি, এ থেকে ধারনা করা হয় যাত্রী ও নাবিকেরা
পরিকল্পিতভাবে জাহাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু এর পরে কোনদিনও তাদের চিহ্ন পাওয়া
যায়নি।
আশ্চর্যজনকভাবে, জাহাজে দিকনির্দেশনার যন্ত্রপাতি ও লগবুকও পাওয়া যায়নি। এটি
তদন্তকারিদের মনে এমন ধারনা দেয় যে নাবিকেরা নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর জন্য জরুরি
জিনিসপত্র নিয়ে জাহাজ ত্যাগ করেছিল। কিন্তু তাদের পুরোপুরি নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এক
রহস্যই থেকে যায়।
অনেকেই এই রহস্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জাহাজে জলদস্যুদের আক্রমন, নাবিকদের
বিদ্রোহ, এমনকি ভিনগ্রহের প্রাণীদের দ্বারা জাহাজের যাত্রীদের উঠিয়ে
নিয়ে যাবার কথাও বলে থাকেন। কেউ কেউ মনে করেন, নাবিকেরা কোন কারনে অপ্রয়োজনীয়ভাবে
আতঙ্কিত হয়ে জাহাজ ছেড়ে চলে যান। আবার কারো মতে, সমুদ্রে তাদের সাথে আরও ভয়াবহ
কিছু ঘটেছিল।
ব্যাপক তদন্ত সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত কোন সুনির্দিষ্ট প্রমান পাওয়া যায়নি।
মৃতদেহ না পাওয়া এবং স্পষ্ট প্রমানের অভাব এই রহস্যকে আরও ঘনীভূত করেছে। সময়ের
সাথে সাথে এম ভি জয়িতা দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের অন্যতম অমীমাংসীত
সামুদ্রিক রহস্যে পরিণত হয়েছে।
Kaz II
Kaz II ছিল একটি ১২ মিটার (প্রায় ৪০ ফুট) দৈর্ঘ্যের
ক্যাটামারান, যাকে ২০ এপ্রিল ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে ভেসে থাকতে দেখা যায়। জাহাজটিকে
একেবারে সুশৃঙ্খল ও অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়, যা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং
সামুদ্রিক বিশেষজ্ঞদের অবাক করে দেয়। এর ভৌতিক নিস্তব্ধতা অচিরেই আধুনিক
নৌযাত্রার ইতিহাসে এক রহস্যময় অধ্যায়ে পরিনত হয়।
উদ্ধারকারী দল যখন Kaz II তে উঠে, তারা জাহাজটিতে কোন দৃশ্যমান ক্ষতির চিহ্ন
খুঁজে পায়নি। জাহাজটির ইঞ্জিন তখনও চালু ছিল, এবং একটি ল্যাপটপকে অন অবস্থায়
পাওয়া গিয়েছিল। টেবিলে সুন্দরভাবে খাবার সাজানো ছিল, আর লাইফ জ্যাকেটগুলো
সুশৃঙ্খলভাবে গোছানো ছিল; এ থেকে বোঝা যায় জাহাজটিতে সবকিছুই ঠিকঠাকভাবেই চলছিল -
হঠাৎ যেন কিছু একটা ঘটে যায়।
এই শান্ত পরিবেশের মাঝেও, তিন সদস্যের নাবিকেরা সম্পুর্নভবে নিখোঁজ ছিল।
জাহাজে কোন ধরনের সহিংসতা, সংঘর্ষ বা বিপদের কোন প্রমান পাওয়া যায়নি। তাই শুরু
থেকেই তদন্তকারীরা এক রহস্যজক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন।
Kaz II এর এই রহস্যময় অবস্থাকে ১৯শ শতকের বিখ্যাত ম্যারি সেলেস্ট জাহাজের
সাথে তুলনা করা চলে। উভয় জাহাজকেই তেমন কোন ব্যাখ্যা বা সুনির্দিষ্ট প্রমান ছাড়াই
পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। এই সাদৃশ্য Kaz II কে ঘিরে সাধারন মানুষের আগ্রহ
এবং কৌতূহলকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
তদন্তকারীরা জাহাজের অবস্থা ও রেকর্ডকৃত তথ্য বিশ্লেষন করে একটি সম্ভাব্য তত্ত্ব
তুলে ধরেন। ধারনা করা হয়, কোন এক নাবিক জাল ফেলার সময় বা যন্ত্রপাতি ঠিক করতে
গিয়ে সাগরে পড়ে যায়। অন্য দুজন তাকে বাঁচাতে পানিতে ঝাপ দেয়, এবং জাহাজের ইঞ্জিন
চালু থাকার কারনে জাহাজটি একা ভেসে চলে যায়; এর জন্য তাদের কেউই আর জাহাজে ফিরে
আসতে পারেনি।
জাহাজের কোথাও কোন সহিংসতা বা যান্ত্রিক ত্রুটির কোন প্রমান না পাওয়ার কারনে এই
তত্ত্বটি বাস্তবসম্মত বলে মনে হয়। আবহাওয়া ও নৌযানের গতিপথ বিবেচনা করেও একে
গ্রহণযোগ্য বলে ধরা হয়ে থাকে। তবে অনেক সামুদ্রিক দুর্ঘটনার মতো এটিও কোন প্রমান
ছাড়াই শুধুমাত্র একটি অনুমানেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজে ব্যাপক তল্লাশি চালানো হলেও কোন মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভব
হয়নি। তাদের পরিবারগুলো অনেক অজানা প্রশ্ন এবং তাদের প্রিয়জনদের সাথে আসলে কি
ঘটেছে তা না জানার বেদনার মধ্যে আটকে থাকে। বিশাল ও ক্ষমাহীন সাগর আসলে কি ঘটেছিল
সে ব্যাপারে আমাদেরকে কোন কিছু জানায়নি।
আজ পর্যন্ত Kaz II এর নাবিকদের সাথে কি ঘটেছিল তা অজানাই রয়ে গেছে। এই জাহাজটি
সামুদ্রিক লোককথায় একটি ভীতিকর স্মৃতি হিসেবে ভেসে বেড়ায় যা আমাদের মনে
করিয়ে দেয় যে সমুদ্রে কত সহজেই বিপদের মুখে পড়া যায়। একটি সাধারন ভ্রমন কীভাবে
চিরতরের জন্য এক রহস্যে রূপ নিতে পারে, Kaz II তার এক নিঃশব্দ সাক্ষী হিসেবে রয়ে
গেছে।
এইচ এম এস ইরেবাস এবং এইচ এম এস টেরর
১৮৪৫ সালে দুটি ব্রিটিশ জাহাজ, এইচ এম এস ইরেবাস (HMS Erebus) এবং এইচ এম এস টেরর (HMS Terror), একটি ঐতিহাসিক অভিযানে যাত্রা শুরু করে। স্যার জন ফ্রাঙ্কলিনের নেতৃত্বে এই
অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল উত্তর মহাসাগরের মধ্যে দিয়ে কিংবদন্তীর
নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ
খুঁজে বের করা। এটি ছিল সেই সময়ের অন্যতম সাহসী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী সামুদ্রিক
অভিযান।
যাত্রা শুরুর পরে, দুটি জাহাজ এবং ১২৯ জন নাবিক একেবারে নিখোঁজ হয়ে যায়। উত্তর
মেরুতে প্রবেশ করার পরে তাদের কাছ থেকে আর কোন বার্তা পাওয়া যায়নি। তাদের এই হঠাৎ
অন্তর্ধান ইতিহাসের অন্যতম এক রহস্যময় সামুদ্রিক ঘটনার জন্ম দেয়।
পরবর্তী কয়েক দশক ধরে নিখোঁজ জাহাজগুলোর সন্ধানে অনেক অনুসন্ধান দল পাঠানো হয়।
এসব মিশনে কেবল কিছু ছিন্নমূল প্রমান (যেমন নাবিকদের ফেলে রাখা ক্যাম্প, তাদের
ব্যাক্তিগত সামগ্রী এবং অদ্ভুত কিছু নোট) পাওয়া যায়। তবে বহু বছর ধরে তাদের
ভাগ্যে আসলে কি ঘটেছিল সে সম্পর্কে কোন নিশ্চিত প্রমান পাওয়া যায়নি।।
এক সময়ে আর্কটিক অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানবদেহের কঙ্কাল ও নাবিকদের ব্যবহার্য
জিনিস পত্র থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পাওয়া যায়। এসব প্রমান থেকে ধারনা করা
হয়, অভিযানের সদস্যরা প্রচন্ড ঠান্ডা, অনাহার এবং খুব সম্ভবত ক্ষুধার জ্বালা
মেটানোর জন্য মৃত নাবিকদের মাংস খেতে বাধ্য হয়েছিল। মৃতদেহে উচ্চমাত্রার সীসার
উপস্থিতি থেকে অনুমান করা হয় জাহাজগুলোতে খাবার বহনকারী ক্যান এবং খাবার পানি
রাখার ট্যাঙ্ক সিসা দিয়ে দূষিত হয়ে গিয়েছিল।
তবে সময়ের সাথে সাথে এই রহস্য অনেকটাই উন্মোচিত হতে শুরু করে। ২০১৪ সালে
ইরেবাস এবং ২০১৬ সালে টেরর জাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়। ঐ
অঞ্চলের আদিবাসী ইনুইটদের মৌখিক ইতিহাস এবং অত্যাধুনিক সোনার (Sonar) প্রযুক্তির
সহায়তায় এই আবিস্কার সম্ভব হয়।
জাহাজ দুটোকে উত্তর মেরুর বরফ শীতল পানির নিচে আশ্চর্যজনক ভালো অবস্থায় পাওয়া
গিয়েছে। এর ভেতরে গবেষকরা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, বাসন কোসন এমনকি অক্ষত বইপত্রও
আবিস্কার করেছেন। কিন্তু তারপরেও সময়ের সাক্ষী হয়ে থাকা এই জাহাজগুলো বহু
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি।
অভিযানটি এত ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হলো কেন, তা আজও আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি।
ক্যাপ্টেন ও নাবিকদের সিদ্ধান্তগত ভুল, প্রতিকূল পরিবেশ, এবং রোগবালাই; সবকিছু
মিলিয়েই হয়তো এই বিপর্যয় ঘটেছিল। জাহাজ দুইটির সাথে আসলেই কি ঘটেছিল তার সম্পূর্ণ
কাহিনী আজও বরফ আর সময়ের গভীরে চাপা পড়ে আছে।
ফ্রাঙ্কলিন অভিযানের কাহিনী একদিকে যেমন একটি করুন ট্র্যাজেডি, তেমনি এটি আমাদের
জন্য একধরনের সতর্কবার্তা হিসেবেও কাজ করে থাকে। এটি মানুষের দিগন্ত পার হয়ে
অজানাকে জানার প্রবনতার মাঝে রোমান্টিকতার সাথে যে বিপদও লুকিয়ে থাকে এবং
প্রকৃতির নির্মম বাস্তবতা, এই দুইটি বিষয় আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়। এই দুই জাহাজের
ভাগ্যে কি ঘটেছিল তার রহস্য তাই বর্তমান ও ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদ ও
অনুসন্ধানপ্রেমীদের মুগ্ধ করে রাখবে।
শেষ কথা
মহাসাগরে কিছু জাহাজ নিখোঁজের ঘটনা প্রবল আবহাওয়া, মানবিক ভুল কিংবা যান্ত্রিক
ত্রুটির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা গেলেও, এরকম অনেক ঘটনা আছে যেগুলো আজও সহজভাবে বোঝা
যায় না। এসব রহস্য ইতিহাসবিদ, নাবিক ও আগ্রহী অনুসন্ধানকারীদের মধ্যে কৌতূহল ও
বিতর্কের জন্ম দিয়ে চলেছে।
এস এস ওরাং মেডান, এস এস ওয়ারাটা, এম ভি জয়িতা এবং ইউ এস এস সাইক্লোপস এর নিখোঁজ
হওয়ার ঘটনাগুলো এখনো মানুষের কল্পনাকে আলোড়িত করে এবং যা আমাদেরকে মহাসাগরগুলোর
বিশাল শক্তি ও মানুষের জ্ঞানের সীমা স্মরন করিয়ে দেয়। এই কাহিনীগুলো শুধু
অমীমাংসিত ধাঁধা নয়; এগুলো ভয়াল স্মারক, যা আমাদেরকে দেখায় কিভাবে সবচেয়ে
শক্তিশালী জাহাজও কোন চিহ্ন ছাড়াই সমুদ্রে অতলে হারিয়ে যেতে পারে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url