বিভিন্ন সভ্যতায় বলি দান করার প্রথা
মানব ইতিহাসে বলিদানের প্রথা এবং এর সাথে জড়িত আচার-অনুষ্ঠান ধর্মীয় ও আধ্যাত্বিক চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। এই আচারগুলো যা প্রায়ই ঈশ্বর, দেবদেবী বা পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে উৎসর্গের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন করা হয়, বিশ্বব্যাপি বিভিন্ন সংস্কৃতির ধর্ম ও বিশ্বাসব্যবস্থার সাথে গভীরভাবে জড়িত।
যদিও বলিদানের রূপ ও তাৎপর্য সংস্কৃতি ভেদে ভিন্ন হতে পারে, তারপরেও অতিপ্রাকৃতিক শক্তিদের তুষ্ট করা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, পাপ মোচন এবং ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মতো মূল থিমগুলো প্রায় সবখানেই বিদ্যমান রয়েছে। এই আর্টিকেলে বিভিন্ন সভ্যতার বলিদান সংক্রান্ত আচারগুলোর তাৎপর্য, পদ্ধতি এবং সময়ের সাথে সাথে সেগুলোর বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
সূচিপত্রঃ বিভিন্ন সভ্যতায় বলি দান করার প্রথা
- বলিদানের প্রথাঃ একটি সর্বজনীন ধারনা
- প্রাচীন মেসোপটেমিয়া এবং তার আশেপাশের এলাকা
- প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতাঃ পরকালীন জীবনের জন্য উৎসর্গ
- মেসোআমেরিকান সভ্যতাঃ দেবতাদের জন্য রক্ত
- প্রাচীন গ্রিস ও রোমঃ বলীদান ও উৎসব
- হিন্দু ধর্মঃ যজ্ঞ এবং প্রতীকী উৎসর্গ
- আব্রাহামিক ধর্মগুলোতে আনুগত্য ও প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে বলিদান
- আদিবাসীদের ঐতিহ্যঃ প্রকৃতি ও আত্মার সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক
- পশু বলিদান নিয়ে বিতর্ক এবং আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি
- শেষ কথা
বলিদানের প্রথাঃ একটি সর্বজনীন ধারনা
ব্যাপক অর্থে বলিদান উচ্চতর কোন শক্তির প্রতি মানষের মূল্যবান কোন কিছু উৎসর্গ
করার কার্যক্রমকে বোঝায়। এই উৎসর্গ প্রাণী, মানুষ, খাদ্য, সামগ্রী বা প্রতীকী
অঙ্গভঙ্গির রূপে দেখা দিতে পারে। এটি বিভিন্ন সংস্কৃতি ও বিশ্বাস ব্যবস্থায় গভীর
ভক্তি, আনুগত্য বা প্রার্থনার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।
নৃতত্ত্ববিদদের মতে, আদিম সমাজে মানুষের প্রকৃতি, স্বাস্থ্য, সমৃদ্ধি ও ভাগ্য
নিয়ন্ত্রণকারী অদৃশ্য শক্তির সাথে সমঝোতার পথ খোঁজার চেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন
সংস্কৃতিতে বলিদান প্রথার উদভব ঘটেছে। এই আচারগুলো প্রায়ই সামাজিক অনুষ্ঠান
হিসেবে পালিত হতো, যা সমাজের সদস্যদের মধ্যকার বন্ধন, শ্রেণিবিন্যাস এবং অভিন্ন
মূল্যবোধকে শক্তিশালী করত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব আচার ধর্মীয় প্রথার অংশ
হয়ে ওঠে এবং তা মানুষের নৈতিক আদর্শ ও সাংস্কৃতিক পরিচয় গঠনে ভূমিকা রাখে।
বলিদানের অনুষ্ঠানকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রতিটি ধরনের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য
থাকে এবং তা আমদেরকে মানব-অতিপ্রাকৃতিক সম্পর্কের ভিন্ন ভিন্ন দিক তুলে ধরে।
এছাড়াও এই বিভাগগুলো আমাদের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বলিদানের পেছনের কারণগুলো বুঝতে
সহায়তা করে।
প্রশমনের বলিদান (Propitiatory sacrifices)ঃ রুষ্ট দেবতা বা
আত্মাকে শান্ত করার জন্য এই বলিদানগুলো দেওয়া হয় যাতে করে তাদের রাগ প্রশমিত হয়
এবং এর ফলে তারা অভিশাপ না দেয়। ভক্তির গভীরতা ও বিনয় প্রকাশ করার জন্য প্রায়ই
জাকজমকপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বলি দেওয়া হয়ে থাকে।
প্রায়শ্চিত্তমূলক বলিদান (Expiatory sacrifices)ঃ ব্যাক্তি বা
সম্প্রদায়কে পাপ বা অপরাধ থেকে মুক্তি দেবার জন্য এবং তাদের নৈতিক এবং
আধ্যাত্মিকভাবে শুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে এই ধরনের বলিদান দেওয়া হয়। প্রতীকী
প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে ভুল সংশোধন সম্ভব এমন বিশ্বাস এই আচার-অনুষ্ঠানে
প্রতিফলিত হয়।
কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বলিদান (Thanksgiving sacrifices)ঃ ব্যাক্তির
জীবনে ভালো কিছু ঘটলে বা সে কোন বিপদ থেকে বেঁচে গেলে এরকম আশীর্বাদের জন্য
ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বলীদান করা হয়। যেমন ভালো ফসল পাওয়া বা
অসুস্থ্যতা থেকে সেরে ওঠার পরে এই ধরনের বলিদান দেওয়া হয়। এটি উপাসক ও ঈশ্বরের
মধ্যে সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করে তোলে।
সংকল্প পূরনের বলিদান (Votive sacrifices)ঃ কোন মানত বা
প্রতিশ্রুতি পূরনের জন্যে এ ধরনের বলিদান করা হয়। যখন কেউ ঈশ্বরের সহায়তা পাওয়ার
বিনিময়ে কিছু উৎসর্গ করার অঙ্গীকার করে, তখন সেই অনুগ্রহ পাওয়ার পর বলিদান দেওয়া
হয়। এই ধরনের বলিদান উচ্চতর আধ্যাত্বিক শক্তি ও তাদের অনুসারীদের মাঝে বিশ্বাস ও
অঙ্গীকারের প্রতীক হিসেবে কাজ করে থাকে।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়া এবং তার আশেপাশের এলাকা
সুমের, আক্কাদ ও ব্যবিলন এর মতো মেসোপটেমিয়ার (বর্তমানের ইরাক) প্রাচীন
সভ্যতাগুলিতে বলিদান ছিল ধর্মীয় জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা বিশ্বাস করত যে
একমাত্র দেবতারাই প্রকৃতি এবং মানুষের ভাগ্যকে তাদের ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রন করতে
পারে, এবং তাদের সেবা করার জন্যই মানব জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে। দেবতাদের সুনজরে
থাকার জন্য বলিদানকে সেই সেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ হিসেবে দেখা হতো।
মেসোপটেমিয়ান মন্দিরগুলোতে দেবতাদের উদ্দেশ্যে ছাগল এবং ভেড়া জবাই করা বেশ
প্রচলিত ছিল। এই পশুগুলো প্রতীকী ও ব্যবহারিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত
হতো। সাধারনত পুরোহিতরা এই বলিদান পরিচালনা করতেন এবং প্রায়শই এর সাথে সাথে
প্রার্থনা এবং শস্য বা ধূপের উৎসর্গও যুক্ত থাকত।
মেসোপটেমিয়ান সংস্কৃতিতে বলিদান শুধু নিয়মিত পূজার অংশ ছিল না, বরং উৎসব, যুদ্ধ
এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও তা করা হতো। সংকটের সময় ঈশ্বরের সহায়তা পাওয়ার আশায়
আরও জাঁকজমকপূর্ণ বলিদান দেওয়া হতো। বলিদানের আকার এবং কত ঘন ঘন বলিদান করা হচ্ছে
তাদের কাছে মহাজগতের ভারসাম্য রক্ষা করার গুরুত্ব বোঝাত।
পৃথিবীর সবচাইতে পুরানো সাহিত্যের মধ্যে অন্যতম
গিলগামেশের মহাকাব্য তে মেসোপটেমিয়ান সভ্যতাতে এই বলিদান প্রথা সম্পর্কে আমদের গুরত্বপূর্ণ তথ্য
প্রদান করে। এই মহাকাব্যে দেবতারা মানবজাতিকে এক বিশাল বন্যা পাঠিয়ে প্রায়
ধংশ করে দেবার পরে বেঁচে থাকা হাতেগোনা কিছু মানুষ দেবতাদের উদ্দেশ্যে আগুনে
পোড়ানো বলিদান উৎসর্গ করে। এতে বলা আছে, এই বলিদানের সুঘ্রাণ দেবতাদের আকৃষ্ট করে
এবং তারা তা গ্রহন করেন।
মহাকাব্যের এই অংশটি মেসোপটেমিয়ান ধর্মীয় বিশ্বাসের একটি মূল ধারনা তুলে
ধরে, বলিদানের মাধ্যমে মানব ও ঈশ্বরের মধ্যকার ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্ক আবার জোড়া
লাগানো সম্ভব। দেবতারা সর্বশক্তিমান হলেও তারা ভক্তদের আন্তরিক উৎসর্গের প্রতি
সাড়া দেন। এই বিশ্বাস তাদের মনে নিয়মিত আচার-অনুষ্ঠান ও ভক্তির গুরত্ত্বকে জোরদার
করত।
মেসোপটেমিয়ান সমাজে মন্দির ছিল এই আচার-অনুষ্ঠানের প্রধান কেন্দ্র, যা একই সাথে
অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করত। বলিদানের জন্য বিশেষভাবে গবাদি
পশু পালন করা হতো এবং বলিদানের বিস্তারিত রেকর্ড রাখা হতো। এই প্রথা
প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল এবং তাদের ধর্মীয় জীবনে সমাজের ভূমিকা জোরদার
করেছিল।
সময়ের সাথে সাথে এই বলিদানপ্রথা পার্শ্ববর্তী সংস্কৃতিগুলিতেও প্রভাব ফেলেছিল এবং
প্রাচীন নিকটপ্রাচ্যের ধর্মীয় বিকাশে অবদান রেখেছিল। মেসোপটেমিয়ান বলিদানমূলক
চিন্তার উপাদান পরবর্তী অনেক ধর্মীয় ঐতিহ্যে লক্ষ্য করা যায়। শৃঙ্খলা, কর্তব্য ও
দেবতাদের তুষ্ট করার গুরুত্ব ঐ এলাকার পরবর্তীকালে উদ্ভব হওয়া সভ্যতাগুলোর কাছে
এই প্রথার দীর্ঘস্থায়ী উত্তরাধিকার (lasting legacy) হিসেবে রয়ে গিয়েছিল।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতাঃ পরকালীন জীবনের জন্য উৎসর্গ
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় বলিদান প্রথা মৃত্যু ও পরকালের ধারনার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে
জড়িত ছিল। তারা বিশ্বাস করত যে মৃত্যুর পরে একটি আধ্যাত্বিক জগতে মৃত ব্যাক্তির
আত্মা তাদের জীবন চালিয়ে যেতে থাকে। মৃত ব্যাক্তির জন্য বলিদান তার সেই পরজগতে
সুষ্ঠভাবে প্রবেশ ও সেখানে তার স্থায়ী জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় রসদের নিশ্চয়তা দিতে
সহায়ক ছিল।
প্রাচীন মিশরে মানব বলিদান অত্যন্ত বিরল ছিল এবং তা মূলত প্রথম দিকের প্রাচীনতম
রাজবংশগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এটি প্রায়ই প্রতীকী রূপে ব্যবহৃত হতো বা রাজকীয়
সমাধির সাথে যুক্ত থাকত, যেখানে প্রয়াত রাজার সেবকদের হত্যা করে তাদের মৃতদেহকে
রাজার সমাধির আশেপাশে কবর দেওয়া হতো। তবে সময়ের সাথে সাথে এই প্রথা বিলুপ্ত হয়
এবং প্রতীকী উৎসর্গ অধিক প্রাধান্য পায়।
পশু বলিদান, বিশেষ করে ষাঁড় উৎসর্গ করা, প্রাচীন মিশরীয় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে
গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে ছিল। সেখানে ষাঁড়কে শক্তি ও উর্বরতার প্রতীক হিসেবে
আধ্যাত্বিকভাবে বিশুদ্ধ মনে করা হতো। নির্দিষ্ট দেবতার সম্মানে মন্দিরে বা কোন
উৎসব উপলক্ষে খোলা জায়গায় এই বলিদান সম্পন্ন হতো।
তবে মিশরীয় সংস্কৃতিতে বলিদানের সবচেয়ে প্রচলিত এবং দীর্ঘস্থায়ী রূপ ছিল খাদ্য,
পানীয় ও সামগ্রীর উৎসর্গ। এই উৎসর্গ দেবতা ও মৃত আত্মা উভয়ের জন্যই করা হতো।
রুটি, বিয়ার, মদ, মাংস, ফল ও ধুপ ছিল সাধারন উৎসর্গ সামগ্রী।
সমাধিগুলোতে বিশদ খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য সামগ্রী রাখা হতো, যাতে মৃত আত্মা
পরকালে এসব খেয়ে টিকে থাকতে পারে। সমাধির দেয়ালে এই সামগ্রীগুলো উৎসর্গ করার
দৃশ্য আঁকা বা খোদাই করা হতো, যাতে মৃত ব্যাক্তির আত্মা পরকালে এসব জিনিসের
আনলিমিটেড সাপ্লাই পেতে পারে। মৃতদের নিয়ে এই অনুষ্ঠানগুলো মৃত্যুর পরে চিরস্থায়ী
জীবনের প্রতি মিশরীয়দের বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করে।
প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি
ছিল
মুখ খোলার অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে একজন পুরোহিত কাঠ বা পাথরের একটি সরঞ্জাম দিয়ে মৃত ব্যাক্তির
মুখ, চোখ, কান এবং শরীরের অন্য অংশগুলোকে হালকা করে স্পর্শ করে মৃত ব্যাক্তির
ইন্দ্রিয়গুলো প্রতীকীভাবে পুনরুজ্জীবিত করতেন যাতে মৃত ব্যাক্তি উৎসর্গ
গ্রহন করতে পারেন। একই সাথে অন্যান্য পুরোহিতরা বিশেষ তন্ত্র, মন্ত্র
উচ্চারন করে এই অনুষ্ঠান সম্পন করতেন।
মিশরীয় ধর্ম বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল
মা'আত
নামের এক ধারনা; যাকে সত্য, ভারসাম্য, শৃঙ্খলা, সম্প্রীতি, আইন, নৈতিকতা এবং
ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে ভাবা হতো। জীবিত ও মৃত উভয়ের ক্ষেত্রে মা'আত রক্ষায়
বলিদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এই আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রাচীন মিশরীয়রা
বিশ্বজগতের সুশৃঙ্খলা বজায় রাখতে ও দেবতাদের সুনজর লাভ করতে চেয়েছিলেন।
মেসোআমেরিকান সভ্যতাঃ দেবতাদের জন্য রক্ত
পৃথিবীর অল্প কিছু সংস্কৃতিই মেসোআমেরিকানদের (বিশেষ করে অ্যাজটেক ও মায়া সভ্যতা)
মতো নাটকীয়ভাবে বলিদান প্রথা পালন করেছিল। এই সভ্যতাগুলোর জন্য, মানব বলি দান
শুধুই ধর্মীয় কর্তব্য ছিল না; এটি ছিল একটি মহাজাগতিক প্রয়োজন। তারা বিশ্বাস করত
যে মানুষের জীবন উৎসর্গ করার মাধ্যমেই বিশ্বে ভারসাম্য বজায় থাকে।
অ্যাজটেকরা বিশ্বাস করত যে তাদের সূর্যদেবতা
হুইৎজিলোপোচলির আকাশপথে তার যাত্রা অব্যহত রাখার জন্য তাকে খাবার ও পানীয়ের যোগান দিতে হবে।
তাকে উদ্দেশ্যে করে বলিদান করা মানুষের রক্ত ও হৃদপিণ্ডই সে খেতে পারত।
অ্যাজটেকরা বিশ্বাস করত এরকম মানব বলিদান করা ছাড়া সূর্য আর আকাশে উদিত হবে
না।
এই মানব বলিদানের রীতিগুলো অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে পালন করা হতো এবং শহরের মাঝখানে
অবস্থিত বিশাল আকারের পিরামিড আকৃতির মন্দিরের চূড়ায় অনুষ্ঠিত হতো। সাধারনত
যুদ্ধবন্দিদের বলির জন্য বেছে নেওয়া হতো এবং তাদেরকে দুইপাশ থেকে ধরে রেখে
আনুষ্ঠানিকভাবে সিঁড়ি বেয়ে উপরে তোলা হতো। যাকে বলি দেওয়া হবে তাকে একটি বদির উপর
জোর করে শুইয়ে দিয়ে তার হাত পা চারিদিক থেকে ধরে রাখা হতো যাতে সে নড়াচড়া করতে না
পারে; এই অবস্থায় একজন পুরোহিত অত্যন্ত ধারালো অবসিডিয়ান পাথরের ছুরি ব্যবহার করে
তার বুক চিড়ে জীবন্ত হৃদপিণ্ড বের করে নিয়ে আসত।
দর্শকদের মনে যাতে ভয় ও শ্রদ্ধা একসাথে জেগে ওঠে, সেজন্য এই অনুষ্ঠানগুলো সবার
সামনে করা হতো। এর ফলে জনগনের কাছে পুরোহিতদের ক্ষমতা এবং শাসকদের প্রজাদের উপর
রাজত্ব করার ঈশ্বর প্রদত্ত অধিকার জোরদার হতো। বাদ্যযন্ত্র, মন্ত্রপাঠ এবং
পুরোহিতদের রঙ্গিন পোশাকের বাহার এই অনুষ্ঠানকে আরও দর্শনীয় করে তুলত।
মায়ান সভ্যতাতেও মানুষ এবং পশু বলি দানের প্রচলন ছিল, যদিও তাদের উৎসর্গপদ্ধতি
কিছুটা আলাদা এবং এর উদ্দেশ্য মূলত কৃষিভিত্তিক ছিল। তাদের সভ্যতায় বলিদান
প্রধানত কৃষি ঋতু, জমির উর্বরতা এবং আবহাওয়ার দেবতাদের আশির্বাদ পাওয়ার জন্য করা
হতো। তারা বিশ্বাস করতে যে, বলিদান করলে দেবতারা তাদেরকে পর্যাপ্ত বৃষ্টি, ভালো
ফসল এবং রাজনৈতিক স্থিতি নিশ্চিত করবে।
মায়ান সমাজে এমন রাজকীয় অনুষ্ঠানগুলোতে প্রায়ই অভিজাত পরিবারের লোকেরা নিজেদের
রক্ত ঝড়াতো। রাজা-রানীরা প্রায়ই তাঁদের জিভ বা গোপনাঙ্গ ছিদ্র করে দেবতাদের
উদ্দেশ্যে রক্ত বের করে দিতেন। তারা মনে করত এভাবে তারা দেবতাদের সাথে আত্মিক
সম্পর্ক স্থাপন করছেন।
এই প্রথাগুলো আধুনিক চোখে নির্মম মনে হলেও, মেসোআমেরিকান সংস্কৃতিতে এগুলো
গুরত্বপূর্ণ সামাজিক ও অ্যাধ্যাত্বিক ভূমিকা পালন করতো। তাঁদের সমাজে মানব
বলিদানকে নিষ্ঠুর ভাবা হতো না, বরং একে তারা উচ্চতর শক্তির সাথে একধরনের
সম্মানজনক ও প্রয়োজনীয় বিনিময় হিসেবে দেখে থাকত। তারা বিশ্বাস করত, এই উৎসর্গের
মাধ্যমেই জীবন, ঋতু এবং প্রকৃতির ধারা বজায় থাকে।
অবশেষে বলা যায়, মেসোআমেরিকান বলিরীতি আমাদের সামনে তাঁদের এমন এক দৃষ্টিভংগিকে
প্রকাশ করে যেখানে ঈশ্বর ও মানুষের জগৎ একে অপরের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে
থাকে। তাঁদের কাছে বলিদান শুধু দেবতাদের কাছে কিছু চাওয়ার উপায়ই ছিল না, বরং তারা
মনে করত যে বলি দেবার মাধ্যমে তারা মহাজাগতিক শৃঙ্খলাও রক্ষা করছে। তারা মনে করত
উচ্চতর শক্তির কাছে কিছু জীবন উৎসর্গ করে তারা দীর্ঘমেয়াদে বাকি সকলের জীবনকে
রক্ষা করে চলেছে।
প্রাচীন গ্রিস ও রোমঃ বলীদান ও উৎসব
প্রাচীন গ্রিক-রোমান সভ্যতায় বলি দানের প্রথা ছিল ধর্মীয় ও নাগরিক জীবনের এক
অবিচ্ছেদ্য অংশ। সাধরনত উৎসব বা গুরুত্বপূর্ণ রাস্ট্রীয় অনুষ্ঠানের সময় বলি দান
করা হতো, এবং এটি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। এগুলো শুধুমাত্র দেবতাদের প্রতি ভক্তি
প্রদর্শন করা নয়, বরং এটি তাঁদের জাতিগত সাংস্কৃতিক পরিচয়কেও প্রতিফলিত
করত।
দেবতাদের উৎসর্গ করার জন্য প্রাণী বলিদান ছিল তাঁদের সবচাইতে প্রচলিত প্রথা। কোন
দেবতাকে সম্মান জানানো হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে সাধারণত ষাঁড়, ভেড়া অথবা শূকর
বলি দান করা হতো। সাধারণত দেবতাদের মুর্তির বেদির কাছে প্রার্থনা এবং তন্ত্র,
মন্ত্র উচ্চারন করা সহ পশু বলি দান করা হতো।
বলিদান করার পরে পশুর মাংস অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হতো। এই
প্রথা বলিদানকে একটি সম্মিলিত সামাজিক ভোজে পরিণত করত, যার ফলে নাগরিকদের মধ্যে
বন্ধন দৃঢ় হতো। এটি মানুষ ও দেবতাদের মধ্যে ঐক্যের প্রতীকও ছিল।
গ্রিক-রোমান সভ্যতায় রক্তবলির বিশেষ তাৎপর্য ছিল এবং তা সাধারণত পাতাললোকের
দেবতাদের জন্য নিবদন করা হতো। এসব বলি দান রাতের বেলায় হতো এবং বলি দেওয়া জীবকে
মাটির নিচে সমাহিত করা হতো। অন্যদিকে, অলিম্পিয়ান দেবতাদের জন্য উৎসর্গ করা জীবের
মৃতদেহ আগুনে দাহ করা হতো, যাতে তার ধোঁয়া স্বর্গে পৌঁছায়।
প্রাচীন গ্রিকেরা
হেকাটোমস্
নামের এক বিশাল বলিদানের উৎসব করত, যেখানে একশ বলদকে বলি দেওয়া হতো। এই ধরনের
বলিদান
প্যানাথেনিয়া
উৎসবের মতো বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হতো, যা জ্ঞানের দেবী অ্যাথিনাকে স্মরনে করা হয়ে
থাকতো। এসব অনুষ্ঠানে বলি দান করে প্রাচীন গ্রিকেরা নিজেদের ধর্মীয় নিষ্ঠা ও
নাগরিক গর্ব উভয়ই প্রকাশ করত।
রোমানরাও সামরিক অভিযান বা রাজনৈতিক ঘটনা শুরু করার আগে পশু বলি দিত। তারা
বিশ্বাস করত যে এই বলির মাধ্যমে তারা দেবতাদের কৃপা ও সুরক্ষা লাভ করবে। এই
বলিদানের প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল এবং একে একটি সুনির্দিষ্ট
প্রক্রিয়া মেনে চলতে হতো। বিশুদ্ধতা, বয়স ও প্রজাতির উপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট
প্রানীকেই দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা যেত। তারা বিশ্বাস করত, এই
প্রক্রিয়ায় সামান্য ভুল হলেও বলিদান বাতিল হয়ে যেত এবং তাঁদের উপর দেবতাদের
অভিশাপ নেমে আসত।
সবশেষে বলা যায়, প্রাচীন গ্রিক-রোমান সভ্যতায় পশু বলিদান প্রথা অনেকগুলো ভূমিকা
পালন করত। এগুলো তাঁদের সমাজে দেবতাদের সম্মান জানানো, সামাজিক শ্রেনিবিন্যাস
মজবুত করা এবং এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য পালন করার মাধ্যমে নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ করত।
দেবতাদের প্রতি উৎসর্গকে সামাজিক উৎসবে পরিনত করে ধর্ম ও রাজনীতি একসুত্রে গাঁথা
হয়ে যেত।
হিন্দু ধর্মঃ যজ্ঞ এবং প্রতীকী উৎসর্গ
প্রাচীন বৈদিক হিন্দুধর্মে যজ্ঞ নামে পরিচিত বলি দান অনুষ্ঠান ছিল ধর্মীয় ও
সামাজিক জীবনের মূল ভিত্তি। এই অনুষ্ঠানগুলো মহাজাগতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও
বিভিন্ন দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য আয়োজন করা হতো। রাজা বা সমাজের পক্ষে
সাধারণত প্রশিক্ষিত ব্রাহ্মণরা এই যজ্ঞ পরিচালনা করতেন।
উৎসবের বস্তু হিসেবে ঘি, শস্য ও সোম (একধরনের পানীয়) ব্যবহার করা হতো। এই উৎসর্গ
করা জিনিসগুলো যাতে দেবতাদের কাছে পৌঁছে যায় সেজন্যে তাদেরকে পবিত্র আগুনে অর্পন
করা হতো। দেবতারা যাতে এই উৎসর্গ গ্রহন করে এজন্যে পুরোহিতরা এই অনুষ্ঠান চলাকালে
বৈদিক মন্ত্র উচ্চারন করে দেবতাদের আহ্বান জানাতো।
অগ্নিদেব ছিলেন এই আচার-অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি ভক্তদের এই উৎসর্গগুলো
দেবতাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিতেন। অগ্নি ছাড়া কোন যজ্ঞই সম্পূর্ণ মনে করা হতো
না।
যজ্ঞ শুধুই অ্যাধ্যাত্বিক ব্যাপার ছিলো না, বরং এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বও
বহন করত। এগুলো প্রজাদের উপর রাজাদের কর্তৃত্ব ও সমাজে ব্রাহ্মণ শ্রেণির ভূমিকা
জোড়দার করত। অশ্বমেধ যজ্ঞ, যেখানে বিশাল সংখ্যক ঘোড়াকে বলি দান করা হতো,
রাজশক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো।
পরবর্তী উপনিষদীয় যুগে হিন্দুধর্মে একটি দার্শনিক পরিবর্তন দেখা দেয়। হিন্দু
ধর্মীয় দর্শন বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান থেকে ব্যক্তিগত আত্মজিজ্ঞাসা ও অ্যাধ্যাত্মিক
চর্চার দিকে গুরুত্ব দিতে থাকে। যজ্ঞের ধারনা তখন মানসিক ও প্রতীকী উতসর্গের
আকারে রূপান্তরিত হয়।
যদিও বৃহৎ যজ্ঞ কমে আসে, তারপরেও ছোট পরিসরের গৃহস্থালী আচার আব্যহত থাকে।
উৎসর্গের ধরন হয়ে ওঠে সহজ ও প্রতীকী, যেখানে ভক্তিই মুখ্য হয়ে উঠে। দৈনন্দিন পূজা
অনেক অঞ্চলে বৃহৎ যজ্ঞের স্থান গ্রহন করে।
উপমহাদেশের কিছু জায়গায় এখনও হিন্দু ধর্মের লোকেদের মধ্যে পশু বলিদানের ঐতিহ্য
বিদ্যমান রয়েছে। এটি বিশেষ করে দেবী উপাসনায় যেমন দুর্গাপূজা ও কালীপূজার সময়ে
পূর্ব ভারত ও নেপালে মহিষ বা পাঠা বলিদান করা হয়ে থাকে। এই বলিদান দেবীর অশুভ
শক্তি দমনের প্রতীক হিসেবে পালিত হয়।
আজকের মূলধারার হিন্দুধর্মে ফল, ফুল ও প্রার্থনার মতো অহিংস উৎসর্গকে গুরত্ব
দেওয়া হয়। যজ্ঞের মূল ভাবনা ভক্তদের আত্মত্যাগ ও নিস্কাম কর্মে পরিণত হয়ছে।
এইভাবে যজ্ঞের রূপ পরিবর্তিত হলেও তার চেতনা হিন্দু ধর্মে গভীরভাবে গেঁথে
আছে।
আব্রাহামিক ধর্মগুলোতে আনুগত্য ও প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে বলিদান
ইহুদিধর্মে বলি বা করবান ধারনাটি মন্দির যুগে (৭০ খ্রিস্টাব্দের আগে) তাঁদের
ধর্মীয় জীবনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। তাঁদের কাছে পশু বলিদান ছিল পাপ মোচন, ঈশ্বরের
কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বা কোন ইচ্ছা পূরণের জন্য ঈশ্বরের কাছে ওয়াদা করার একটি
উপায়। তাঁদের সভ্যতায় বলি দান করার মাধ্যমে সমাজ ও ঈশ্বরের মধ্যে একটি আধ্যাত্বিক
সংযোগ তৈরি হতো।
ইহুদিদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ তোরাতে বিভিন্ন ধরনের বলির বিবরন রয়েছে, যার প্রতিটি
আবার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও নিয়ম দ্বারা পরিচালিত। ওলাহ্ বা দহনবলিতে ঈশ্বরের
প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য বাছাই করা পশুকে জবাই করে সম্পূর্ণ পশু আগুনে পুড়িয়ে
ছাই করে দেওয়া হতো। আবার শাতাত ও শেলানিম অনুষ্ঠানে পাপের প্রায়শ্চিত্ত ও সামাজিক
ঐক্য সাধনের জন্য পশু বলি দান করা হতো।
এই বলিদান কেবলমাত্র মন্দিরে নিযুক্ত যাজকরা (কোহানিম) সম্পাদন করতে
পারতেন। শারীরিকভাবে নিখুঁত ও দাগবিহীন পশুই বলির জন্য বাছাই করা হতো, এবং
প্রতিটি ধাপই কঠোর নিয়ম অনুসারে পরিচালিত হতো। বলি প্রথা ইহুদিদের উপাসনা ও
জাতিগত পরিচয়ের একটি বড় অংশ ছিল।
তবে ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা জেরুজালেমে ইহুদিদের এই প্রধান মন্দির ধ্বংস করে
দেবার পরে এই প্রথায় বড় পরিবর্তন আসে। যেহেতু ইহুদিরা তাঁদের ধর্মগ্রন্থ অনুসারে
এই মন্দির প্রাঙ্গন ছাড়া অন্য কোথায় পশু বলি দান করতে পারত না, তাই এই মন্দির
ধ্বংস হয়ে যাবার পরে ইহুদিধর্মে বলি প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। এর পরিবর্তে ইহুদিরা
প্রার্থনা, ধর্মীয় শিক্ষা, দান ও নৈতিক জীবনে গুরুত্ব দেয়।
খ্রিষ্টানধর্ম ইহুদি ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত হলেও তারা বলির ধারনাকে নতুনভাবে
ব্যাখ্যা করে। যিশু খ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়াকে খ্রিস্টানরা মানবজাতির পাপের
জন্য একবারেই চূড়ান্ত ও চিরস্থায়ী বলি দান হিসেবে দেখে থাকে। খ্রিষ্টানধর্মে যিশু
খ্রিস্টের আত্মউৎসর্গের মাধ্যমে বারবার বলি দেবার প্রয়োজন শেষ হয়েছে বলে বিশ্বাস
করা হয়।
এর বদলে ইউক্যারিস্ট, বা হলি কমিউনিওন খ্রিস্টান ধর্মের কেন্দ্রীয় উপাসনায় পরিণত
হয়। এখানে তারা যিশুর দেহ ও রক্তের প্রতীক হিসেবে রুটি ও মদ পান করে তাঁর সাথে
একাত্বতা বোধ করে। এই প্রতীকী বলির মাধ্যমে খ্রিস্টানরা যিশুর মৃত্যু ও
পুনরুত্থানকে স্মরন করে।
আল্লাহ্র আদেশের প্রতি হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর আনুগত্যের কাহিনীর সঙ্গে ইসলাম
ধর্মে বলির ধারনা জড়িয়ে আছে। ইসলামের দুটি প্রধান উৎসবের মধ্যে একটি, ঈদুল
আযহা, ইব্রাহিম (আঃ) তাঁর নিজের ছেলের গলায় ছুরি চালানোর প্রস্তুতির স্মরনে পালন
করা হয়ে থাকে। কিন্তু আল্লাহ্র আদেশে শেষ মূহূর্তে তাঁর ছেলের জায়গায় একটি পশু
কোরবানি করা হয়েছিল, যা থেকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আল্লাহর প্রতি মানুষের পশু
বলিদানের একটি উদাহরন সৃষ্টি হয়।
মুসলিমরা ঈদুল আযহার সময় সাধারনত ছাগল, ভেড়া, গরু, মহিষ, উট ও দুম্বা উৎসর্গ করে
থাকেন। কোরবানির মাংস তিনভাগে ভাগ করা হয়ঃ এক ভাগ নিজের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়দের
জন্য, আর এক ভাগ গরিবদের জন্য। এই প্রথা ইসলামে আত্মসমর্পন, দানশীলতা ও
কৃতজ্ঞতার মূল্যবোধকে দৃঢ় করে।
আদিবাসীদের ঐতিহ্যঃ প্রকৃতি ও আত্মার সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক
প্রকৃতি ও আত্মাদের সাথে পারস্পরিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন
আদিবাসী সম্প্রদায় বহু প্রাচীনকাল থেকে বলি প্রথা চর্চা করে আসছে। নেটিভ
আমেরিকান, সাইবেরিয়ান শামান ও আফ্রিকার আদিবাসী সমাজগুলো এই প্রথায় গভীর বিশ্বাস
রাখে। এসব বলি সাধারণত অতিপ্রাকৃতিক শক্তি, পূর্বপুরুষ বা দেবতাদের প্রতি শ্রদ্ধা
ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়।
উতসর্গ করা সামগ্রিগুলোর মধ্যে সাধারণত খাবার, তামাক অথবা প্রাণী থেকে থাকে। তারা
যে জায়গায় বসবাস করে তার ভূমি, আবহাওয়া এবং অতিপ্রাকৃত শক্তিগুলোর সাথে শান্তি
বজায় রাখতে এসব বলিদান করা জিনিস উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। এই আচার-অনুষ্ঠান গুলোর
পেছনে প্রকৃতি থেকে যা নেওয়া হয়েছে তা ফেরত দিতে হবে এরকম একটি ধারনা কাজ
করে।
উত্তর আমেরিকার নেটিভ আমেরিকান সম্প্রদায়গুলোতে বলি প্রথা ঋতুভিত্তিক উৎসব ও
পারিবারিক আচার-অনুষ্ঠানের অংশ ছিল। তামাক ও ভুট্টা প্রায়ই গ্রেট স্পিরিট (The
Great Spirit) ও অন্যান্য পবিত্র সত্তার প্রতি উৎসর্গ করা হতো। এই রীতিগুলি তাদের
প্রকৃতির উপর কৃতজ্ঞতা এবং নির্ভরশীলতা প্রকাশ করত।
উত্তর মেরুর আর্কটিক অঞ্চলে বসবাস করা ইনুইট জনগোষ্ঠী (যারা এস্কিমো নামে আমাদের
কাছে বেশি পরিচিত) তারা যে সকল প্রাণী শিকার করত তাদের আত্মাকে সম্মান জানানোর
জন্য আচার-অনুষ্ঠান পালন করত। একটি সফল শিকারের অভিযানের পরে তারা মৃত প্রানির
দেহের কিছু অংশ ভূমি বা সাগরে ফিরিয়ে দিত। তারা বিশ্বাস করতে এর ফলে প্রাকৃতিক
শক্তিগুলো সন্তুষ্ট থাকবে এবং তাদেরকে ভবিষ্যতে বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে।
পশ্চিম আফ্রিকার ভডুন (Vodun) এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের সান্তেরিয়া (Santeria) এবং
ক্যান্ডোম্লে (Candomble) নামের স্থানীয় ধর্মগুলোতে পশুবলিদান একটি কেন্দ্রিয়
ভূমিকা পালন করে। এসব ধর্মের অনুসারীরা অরিশাস (Orishas) বা অতিপ্রাকৃত
শক্তিগুলোর কাছে জীবনে কঠিন অবস্থায় পড়লে কি করতে হবে তার জন্য দিকনির্দেশনা,
অসুখ থেকে মুক্তি লাভ এবং বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পশু বলিদান করে থাকে।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সাংস্কৃতিক সংমিশ্রন ও নানা রকম বাধা নিষেধের
মধ্যেও এসব প্রথা এখনও টিকে আছে।
এই বলিগুলো একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে পরিচালিত হয় এবং তাদের সমাজে এগুলোকে পবিত্র
কর্তব্য হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। সংগীত, নৃত্য ও প্রার্থনার মাধ্যমে এগুলোর আয়োজন
করা হয়, যা সমষ্টীগতভাবে গভীর আধ্যাত্বিক অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে। পশ্চিমা বলি দান
ধারনার এর পার্থক্য পরিস্কার হয়ে ওঠে, এখানে বলি দান করা পাপ বা শাস্তির প্রতীক
নয়; বরং বলিদান করার মাধ্যমে তারা অদৃশ্য, অতিপ্রাকৃতিক জগতের সাথে তাদের জীবনের
সংযোগকে স্বীকার করে নেয়। এই প্রথার মাধ্যমে পৃথিবীর আদিবাসী সংস্কৃতিগুলো আমাদের
এই বিশাল এবং জীবন্ত মহাবিশ্বে তাদের স্থানকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে।
পশু বলিদান নিয়ে বিতর্ক এবং আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি
আধুনিক নৈতিকতা বোধ ও প্রানী কল্যানের ধারনার সাথে ঐতিহ্যবাহী বলি প্রথার
ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষ দেখা যাচ্ছে। যেসব আচার অনুষ্ঠানে পশু ব্যবহার বা পশুর প্রতি
সহিংসতা যুক্ত রয়েছে, সেগুলোকে অনেকেই আজ অমানবিক ও পুরনোপন্থী বলে সমালোচোনা
করেন। প্রানী অধিকার রক্ষাকারী সংগঠন, ধর্মীয় সংস্কারপন্থীরা ও ধর্মনিরপেক্ষ
সংগঠনগুলো অনেক সময় এসব রীতি নিষিদ্ধ বা সংস্কার করার দাবী জানিয়েছে।
তবে অনেক ধর্মের অনুসারীরা এই বলি প্রথাগুলিকে পবিত্র ভাবেন এবং এই প্রথাকে
পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য হিসেবে রক্ষা করার পক্ষেই মত প্রকাশ করে থাকেন। তাঁদের মতে,
বলিদান একটি গভীর আধ্যাত্মিক কাজ যা তাঁদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও ধর্মীয় কর্তব্যের
সাথে জড়িত। এই রীতিগুলির উপর নিষেধাজ্ঞা তাঁদের কাছে নিজের সংস্কৃতির উপর আক্রমন
বলে মনে হয়।
পরিবর্তিত মূল্যবোধের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলি দান প্রথায় অনেক পরিবর্তন এসেছে।
পশুবলির পরিবর্তে এখন অনেক জায়গায় প্রতীকী উৎসর্গ যেমন নারিকেল ভাঙা, প্রদীপ
জ্বালানো বা খাবার বিতরন করা হয়। এর ফলে বলি দান প্রথার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বজায়
থাকে, আবার সেগুলো আধুনিক রুচি ও মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখে।
কিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বলি দান প্রথার বিকল্প হিসেবে সেবামূলক কাজ বা দানকেই
ঈশ্বরের প্রতি উৎসর্গের রূপ হিসেবে তুলে ধরছে। নিজেদের সময়, শ্রম এবং সম্পদ
উৎসর্গ করে সমাজের উপকার করা এখন একধরনের নতুন ভক্তির প্রকাশ হয়ে উঠেছে। এই
পরিবর্তনগুলি বলিদান প্রথাকে আধুনিক নৈতিক জগতে প্রাসঙ্গিক করে রাখছে।
একাডেমিকভাবে এখন বলি দান প্রথাকে আর কেবল অন্ধবিশ্বাস বা নৃশংসতা হিসেবে দেখা হয়
না। গবেষকেরা একে এক গভীর সাংস্কৃতিক প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করেন, যা মানুষকে
জীবন, মৃত্যু, নৈতিকতা ও পবিত্রতার প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি দাঁড় করায়। বলি দান
প্রথা যেকোন রূপে মানুষের অতিপ্রাকৃতিক শক্তির সাথে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টার
প্রতিফলন ঘটায়।
শেষ কথা
বলি দান প্রথা সংস্কৃতি ও সভ্যতাভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকলেও তা মানুষের সাধারন
জীবনের সীমা ছাড়িয়ে অদৃশ্য, অপার্থিব, অতিপ্রাকৃত শক্তির সাথে সংযোগ স্থাপন করার
এক চিরকালীন আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করে। অ্যাজটেকদের রক্তাক্ত মানব বলি দান থেকে
শুরু করে আধুনিক উপাসকদের নিঃশব্দ প্রার্থনা পর্যন্ত, বলি মানব ও অতিপ্রাকৃতের
মধ্যে এক সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে আসছে।
অনেক প্রাচীন রীতি বিলুপ্ত বা রূপান্তরিত হয়ে গেলেও, উচ্চতর কোন উদ্দেশ্যের জন্য
কিছু ত্যাগ করার ধারনা আজও আমাদের মাঝে জীবিত আছে। এসব প্রথা নিয়ে পড়াশোনা করলে
আমরা কেবল ইতিহাস ও ধর্ম নয়, মানুষের চিরন্তন বিশ্বাস ও ভক্তির প্রকৃতিও গভীরভাবে
অনুধাবন করতে পারি।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url