কাল্ট নিয়ে কিছু কথা
কঠোর নিয়ন্ত্রণাধীন গোষ্ঠী বা কাল্ট বহুদিন ধরেই জনসাধারনের কৌতুহলের বিষয় হয়ে
এসেছে, যেগুলোকে গনমাধ্যমে প্রায়ই গোপনীয় ও প্রতারণামূলক সংগঠন হিসেবে উপস্থাপন
করা হয়। তবে এইধরনের অতিরঞ্জিত উপস্থাপনের বাহিরেও কাল্টের বাস্তবতা অনেক বেশি
জটিল এবং বহুমাত্রিক হয় থাকে।
কাল্টগুলোতে একনায়কতান্ত্রিক নেতৃত্ব, কঠোর মতাদর্শনগত নিয়ন্ত্রন, সদস্যদের উপর
গভীর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব এবং শক্তিশালী গোষ্ঠীগত সংহতি এর মতো কিছু
সাধারন বৈশিষ্ঠ্য দেখা যায়। এই প্রবন্ধে কাল্টের সংজ্ঞা, তাদের টিকে থাকার মানসিক
প্রক্রিয়া, ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক উদাহরন, সদস্য সংগ্রহ ও প্রভাবিত করার কৌশল, এবং
তাদেরকে নিয়ে সমাজ ও আইনের প্রতিক্রিয়া আলোচনা করা হয়েছে।
সূচিপত্রঃ কাল্ট নিয়ে কিছু কথা
কাল্ট কি?
কাল্ট শব্দটি বিতর্কিত এবং এটি প্রায়ই মানুষের মনে আবেগপ্রবন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি
করে। কাল্ট শব্দটি ল্যাটিন Cultus শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ উপাসনা
বা ধর্মীয় অনুশীলন। তবে এই শব্দটির আধুনিক ব্যবহারে এটি সাধারণত এমন একটি সামাজিক
গোষ্ঠী বোঝাতে ব্যবহৃত হয় যারা ধর্মীয়, দার্শনিক বা আধ্যাত্মিক বিশ্বাসে প্রথাগত
ধারনার বাহিরে গিয়ে নতুন ধরনের সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলেন। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল
অ্যাসোসিয়েশন (APA) এর মতে, কাল্ট হলো "একটি গোষ্ঠী বা আন্দোলন, যেটি সাধারণত কোন
চরমপন্থী মতাদর্শে নিবেদিত থাকে এবং তা একজন ক্যারিশমাটিক নেতার মাধ্যমে পরিচালিত
হয়ে থাকে।"
কাল্ট শব্দের অস্পষ্টতা একে ধ্বংসাত্বক কাল্ট ও নিরীহ কাল্টের মধ্যে পার্থক্য
তৈরির প্রয়োজনীয়তা তৈরি করেছে; যেখানে ধ্বংসাত্বক কাল্ট তাদের সদস্যদের ব্রেইন
ওয়াশ করে এবং তাদের নাজুক মানসিক অবস্থার অপব্যবহার করে থাকে, আর নিরীহ কাল্টে
নতুন এবং অভিনব সামাজিক, দার্শনিক কিংবা আধ্যাত্মিক ধারার চর্চা করা হলেও তা
ক্ষতিকারক হয় না। বর্তমানে অনেক গবেষক তাই কাল্টকে বর্ননা করতে উচ্চ-নিয়ন্ত্রন
গোষ্ঠী (High Control Group) বা নতুন ধর্মীয় আন্দোলন (New Religious
Movement) শব্দগুলো ব্যবহার করতে পছন্দ করেন যাতে কাল্ট শব্দটির নেতিবাচক
ইঙ্গিতগুলো এড়ানো যায়। তা সত্ত্বেও একটি কাল্টের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো হলোঃ
- একনায়কতান্ত্রিক নেতৃত্বঃ যেকোন কাল্টের পরিচালনায় থাকেন একজন কেন্দ্রীয়, ক্যারিশমেটিক নেতা যিনি তার ভক্তদের কাছ থেকে প্রায়শই নিঃশর্ত আনুগত্য দাবি করেন। এই নেতাকে সাধারণত ভুলহীন, নিখুঁত মানব হিসেবে ভক্তদের কাছে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে এবং তিনি নিজেকে ঈশ্বর, পৃথিবীতে মানবরুপে আবির্ভূত হওয়া ঈশ্বরের অবতার অথবা ঈশ্বরের দূত হিসেবে বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী বা অন্যান্য অতিপ্রাকৃতিক শক্তির অধিকারী দাবী করতে পারেন। কাল্টে তার কর্তৃত্বের প্রতি প্রশ্ন তোলাকে নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে কিংবা তা শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত হয়।
- বিচ্ছিন্নতাঃ কাল্টের সদস্যদের বাইরের প্রভাব এবং তাদের পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক থেকে আলাদা করে রাখা হয়ে থাকে। পরিবার ও বন্ধুদের সাথে তাদের যোগাযোগ সীমিত বা নিরুৎসাহিত করা হয়। এই বিচ্ছিন্নতাই কাল্টের সদস্যদের তাদের নিজেদের উপর নির্ভরশীলতা আরও বাড়িয়ে তোলে।
- নিয়ন্ত্রনঃ সদস্যরা কেমন করে আচরন করবে, তারা কি চিন্তা ভাবনা করতে পারবে এবং তারা কেমন করে আবেগ প্রকাশ করবে তার উপর কঠোর নিয়ন্ত্রন আরোপ করা হয়। তারা কি পোশাক পরিধান করতে পারবে, কি খেতে পারবে, কেমন করে কথা বলবে এমনকি কার সাথে তারা ব্যক্তিগত সম্পর্ক রাখতে পারবে তা নিয়েও কঠোর নিয়ম কানুন থাকতে পারে। কাল্টের সদস্যদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করাকে প্রায়শই বিশ্বাসঘাতকতা বা বিপজ্জনক বলে উপস্থাপন করা হয়।
- প্রভাবিতকরনঃ কাল্টের সদস্যদের নেতার উপর আনুগত্য এবং বিশ্বাস বজায় রাখতে নানারকম মনস্তাত্ত্বিক চাপ প্রয়োগ করা হয়। এই কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে কাল্টের যে সদস্য বা সদসস্যদের আনুগত্য নিয়ে সন্দেহ করা হয় তাদের মনে ভয় এবং অপরাধবোধ জাগিয়ে তোলা, তাদেরকে অতিরিক্ত ভালোবাসা দেখানো বা অন্যান্য সদস্যদের দিয়ে তাদের মনে মানসিক চাপ সৃষ্টি করা। সময়ের সাথে সাথে কাল্টের সদস্যরা তাদের গোষ্ঠীর মতাদর্শকে তাদের নিজেদের বিশ্বাস হিসেবে গ্রহন করে নেন।
- শোষনঃ কাল্টের সদস্যরা তাদের নেতার দ্বারা আর্থিক, মানসিক এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হতে পারেন। প্রায়শই তাদেরকে কাল্টের নামে নিজেদের অর্থ, শ্রম বা ব্যক্তিগত সম্পদ দান করতে উৎসাহিত বা বাধ্য করা হয়ে থাকে। চরম ক্ষেত্রে, এই ধরনের নির্যাতনকে আধ্যাত্মিক উন্নয়ন বা ভক্তির প্রমান হিসেবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে।
মানুষ কেন কাল্টে যোগদান করে?
মানুষ কেন কাল্টে যোগ দেয় এবং তাতে থেকে যায়, তা বুঝতে হলে মানুষের মনস্তত্ত্ব
বিশ্লেষন করা প্রয়োজন। সাধারণত মানুষ নিজের ইচ্ছায় কাল্টে যোগ দেয় না; বরং
জীবনের দুর্বল সময়ে (যেমন, ব্যাক্তিগত ক্ষতি, অস্তিত্ব সংকট বা সামাজিক
বিচ্ছিন্নতার সময়ে) কাল্টই তাদেরকে খুঁজে নেয়। জীবনের এই কঠিন মূহুর্তগুলোতে
মানুষ অর্থ, স্বীকৃতি বা পরিত্রানের প্রুতিশ্রুতির প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে,
আর কাল্টরা এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে তাদের সদস্য সংগ্রহ করে।
কগনিটিভ ডিসোন্যান্স
মনোবিজ্ঞানী লিওন ফেস্টিঞ্জার (Leon Festinger) সর্বপ্রথম কগনিটিভ ডিসোন্যান্স
(Cognitive Dissonance) ধারনাটি উপস্থাপন করেন; তার মতে এটি হলো এমন এক ধরনের
মানসিক অস্বস্তির ভাব, যা মনের মধ্যে পরস্পরবিরোধী বিশ্বাসগুলোকে একসাথে ধরে
রাখলে অনুভব করা যায়। কাল্টগুলো এই ব্যাপারটিকে কাজে লাগিয়ে তাদের সদস্যদের মনে
এমন বিতর্কিত বিশ্বাস ব্যবস্থা তৈরি করে যা তাদেরকে নিজেদের কাছে বারবার মানিয়ে
নেবার প্রয়োজন হয়। যখন কাল্টের সদস্যরা এমন কাজ করে যা তাদের ব্যাক্তিগত
মূল্যবোধের সাথে যায় না (যেমন পরিবারের সদস্যদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা), তখন
সেই অস্বস্তি দূর করার উপায় হিসেবে তারা তাদের কাল্টের প্রতি আরও গভীর আনুগত্য
প্রকাশ করে।
মানসিক নিয়ন্ত্রন ও মগজ ধোলাই
কাল্টের সদস্যদের ইচ্ছে করে ঠিকমতো ঘুমাতে না দেওয়া, তাদের কাছ থেকে নিজেদের
জীবন সম্পর্কে স্বীকারোক্তি আদায় করে নেওয়া এবং তাদেরকে কাল্টের ম্যাসেজ বা
বার্তা বারবার মনে করিয়ে দেবার মতো কৌশলগুলো কাল্টের সদস্যদের ভালো করে চিন্তা
ভাবনা করার শক্তিকে দুর্বল করে দেয়। কাল্ট নেতারা প্রায়ই লাভ বোম্বিং (Love
Bombing) দিয়ে কাল্টের যাত্রা শুরু করেন; তারা কাল্টের নতুন সদস্য নিয়োগ করার
সময় অতিরিক্ত স্নেহ ভালোবাসা দেখিয়ে তাদেরকে তার উপরে মানসিকভাবে নির্ভরশীল করে
গড়ে তোলেন। এভাবে কাল্টের সদস্যদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হলে, নেতারা তাদের
উপর ধীরে ধীরে কঠোর নিয়ম কানুন ও নিয়ন্ত্রনমূলক মতবাদ চাপিয়ে দেন।
দলগত চিন্তাভাবনা এবং মানিয়ে চলার প্রবণতা
মানুষের নিজেদের সমাজের অংশ হবার এবং সমাজের সাথে মানিয়ে চলার মানবিক আকাঙ্খা
অনেক সময় ব্যক্তিগত বিচক্ষণতাকে অতিক্রম করে যায়। কাল্টগুলো এই মনোভাবকে "আমরা
বনাম তারা" মানসিকতা প্রচার করে আরও বাড়িয়ে তোলে, যেখানে বাইরের মানুষদের তাদের
সংগঠনের জন্য হুমকি হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে। এর ফলে তাদের দলীয় পরিচয় শক্তিশালী
হয় এবং সদস্যদের কাল্টের নিয়ম কানুন নিয়ে প্রশ্ন তোলা এবং নিজেদের মধ্যে
মতবিরোধ করা বন্ধ হয়ে যায়।
ভয় এবং অপরাধবোধ
অনেক কাল্ট তাদের অনুসারীদের মনে এমন এক ভয় তৈরি করে, যাতে নেতা বা গুরুকে
প্রশ্ন করলেই শাস্তি, সমাজ থেকে বাদ পড়ে যাওয়া, বা চিরদিনের জন্য নরকে যাওয়ার
ভয় থাকে। এই ভয় সদস্যদের মনে এমন এক মানসিক বাধা তৈরি করে, যা তাদের গুরুর
বিরুদ্ধে কিছু বলার বা সন্দেহ করার সাহস কেড়ে নেয়।
আর যখন সদস্যরা কোনো ভুল বা অনৈতিক কাজ করে ফেলে, তখন তাদের মনে যে অপরাধবোধ জন্মায়, সেটাকেও কাল্টের নেতা কাজে লাগায়। তারা সেই অপরাধবোধকে এমনভাবে দেখায় যেন এটা ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া, বা কোনো মহৎ উদ্দেশ্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা। ফলে, সদস্যরা নিজেদের দোষী মনে করে আরও বেশি নেতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
আর যখন সদস্যরা কোনো ভুল বা অনৈতিক কাজ করে ফেলে, তখন তাদের মনে যে অপরাধবোধ জন্মায়, সেটাকেও কাল্টের নেতা কাজে লাগায়। তারা সেই অপরাধবোধকে এমনভাবে দেখায় যেন এটা ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া, বা কোনো মহৎ উদ্দেশ্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা। ফলে, সদস্যরা নিজেদের দোষী মনে করে আরও বেশি নেতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
ইতিহাসের কিছু কুখ্যাত কাল্ট
কাল্টের উৎপত্তি ও বিস্তারলাভ করা কোন আধুনিক ঘটনা নয়। ইতিহাসে এর বহু উদাহরন
রয়েছে, তারপরেও বিংশ শতকে পশ্চিমা দেশগুলোতে কাল্টভিত্তিক সামাজিক এবং
আধ্যাত্মিক আন্দোলনের নাটকীয় উত্থান ঘটে। নিচে এরকম কিছু কাল্টের সংক্ষিপ্ত
বর্ননা দেওয়া হলোঃ
পিপলস টেম্পল এবং জোন্সটাউন
সম্ভবত আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে কুখ্যাত কাল্ট ছিল পিপলস টেম্পল, যার উৎপত্তি,
বিকাশ ও নেতৃত্ত্বে ছিলেন জিম জোন্স। তিনি একজন ক্যারিশম্যাটিক ধর্মপ্রচারক
ছিলেন, যিনি ষাটের দশকের বর্নবাদি আমেরিকান সমাজে মানুষে মানুষে বর্নগত সমতা ও
সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনুসারীদের আকৃষ্ট করেছিলেন। তার বার্তা
বিশেষ করে আমেরিকার প্রান্তিক ও নিপীড়িত মানুষদের (বিশেষ করে যারা তাদেরকে
গ্রহন করবে এরকম একটি সম্প্রদায় ও তাদের জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজছিলেন) কাছে
আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছিল।
পিপলস টেম্পল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার যাত্রা শুরু করলেও, পরবর্তীতে তারা
বিভিন্ন বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার কারনে তারা তাদের সংগঠনটিকে দক্ষিন আমেরিকার
গায়ানায় সরিয়ে নিয়ে যায়। জিম জোন্স সেখানে গভীর জঙ্গলের ভেতরে জোন্সটাউন নামে
তার অনুসারীদের জন্য একটি দূরবর্তী বসতি স্থাপন করেন, যেটিকে তিনি গনমাধ্যম ও
বাইরের মানুষদের কাছে এক আদর্শ সমাজ বলে উপস্থাপন করতেন। তবে বাস্তবে সেখানে
জীবন ছিল কঠোর, আর সেখানে বসবাস করা কাল্টের সদস্যরা নজরদারি, প্রতারনা ও
নিয়ন্ত্রনের শিকার হয়েছিলেন।
জোন্স তার অনুসারীদের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ত্ব বজায় রাখতেন এবং ভয়ভীতি, প্রচারনা ও
মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের আনুগত্য ধরে রাখতেন। তার কাল্টে কোন রকম ভিন্ন
মত সহ্য করা হতো না, এবং সদস্যদের বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো।
সময়ের সাথে সাথে জোন্সটাউনের অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে, এবং জোন্স আরও
সন্দেহপ্রবন ও বিভ্রান্তিপূর্ণ হয়ে ওঠেন।
১৯৭৮ সালে মার্কিন কংগ্রেসম্যান লিও রায়ান অভিযোগ অনুসন্ধানে জোনস্টাউন
পরিদর্শনে যান। তিনি কাল্টের কিছু সদস্যদের, যারা স্বেচ্ছায় জোনস্টাউন ছেড়ে চলে
যেতে চেয়েছিল, নিয়ে বিমানবন্দরের দিকে রওনা দেবার সময় রায়ান ও আরও কয়েকজনকে
কাল্টের নিরাপত্তারক্ষীরা গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনার পরপরই অবস্থা বেগতিক
দেখে জিম জোন্স তার কাল্টের সকল সদস্যদের সম্মিলিত আত্মহত্যার নির্দেশ
দেন।
নয়শরও বেশি মানুষ, যাদের মধ্যে শিশুরাও ছিল, পটাশিয়াম সায়ানাইড মিশানো কোমল
পানীয় পান করে আত্মহত্যা করেন, যা ইতিহাসে "জোনস্টাউন হত্যাকাণ্ড" নামে কুখ্যাত
হয়ে আছে। অনেক সদস্যকে জোর করে বিষ পান করানো হলেও, কাল্টের বেশীরভাগ
সদস্যই একে একধরনের বিপ্লবী কাজ মনে করে স্বেচ্ছায় গনআত্মহত্যায় অংশগ্রহন করেন।
এই ট্রাজেডি কাল্টের নেতৃত্ত্বের প্রতি অন্ধ অনুগত্য এবং সমাজ থেকে
বিচ্ছিন্নতার ভয়াবহ পরিনতির একটি করুন উদাহরন হয়ে আছে।
হেভেনস্ গেইট
মার্শাল অ্যাপল হোয়াইট ও বনি নেটলস্ হেভেনস্ গেইট নামে পরিচিত এই কাল্টের
নের্তৃত্ত্বে ছিলেন। তারা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, খ্রিস্টান ধর্মের কিছু পরিভাষা
এবং মহাপ্রলয়ের ভাবনা মিশিয়ে মানুষের মাঝে এক ধরনের ব্যাতিক্রমধর্মী বিশ্বাস
প্রচার করতেন। তাদের মূল বিশ্বাস ছিল, মৃত্যুর পরে একটি মহাকাশযান তাদের
কাল্টের সদস্যদের আত্মাকে একটি উচ্চতর অস্তিত্বের স্ত্বরে নিয়ে যবে।
অ্যাপলহোয়াইট ও নেটলস দাবি করতেন যে তারা মানুষের রূপ নিয়ে ভিনগ্রহ থেকে
পৃথিবীতে আগত হয়েছেন, যাতে করে তারা অন্যদেরকে "নেক্সট লেভেলে" এ পৌঁছাতে
সাহায্য করতে পারেন। তারা বিশ্বাস করতেন পৃথিবী শীঘ্রই ধ্বংস হয়ে যাবে এবং যারা
তাদের অনুসরন করবে তারাই কেবল এই মহাপ্রলয় থেকে রক্ষা পাবে। তাদের এই শিক্ষায়
অনুপ্রাণিত হয়ে একটি ছোট কিন্তু নিবেদিত অনুসারী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে।
সময়ের সাথে সাথে এই কাল্টের সদস্যরা বাইরের জগত থেকে আরও বিছিন্ন হয়ে পড়ে। তারা
কঠোর নিয়ম মেনে চলত, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ত্যাগ করত এবং সমাজে নিজেদের পরিচয়
মুছে ফেলতে নিজেদের নামও পরিবর্তন করত। ১৯৮৫ সালে বনি নেটলস্ এর মৃত্যুর পরে
কাল্টে মার্শাল অ্যাপল হোয়াইটের কর্তৃত্ত্ব আরও বেড়ে যায়, কারন তিনি দাবি করেন
নেটলস্ আগেই উচ্চতর অস্তিত্বের স্তরে পৌছে গিয়েছে।
১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে কাল্টের সদস্যরা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে হেল-বপ
ধুমকেতুর পেছনে একটি মহাকাশযান রয়েছে যা তাদেরকে আসন্ন বিপর্যয় থেকে রক্ষা
করবে। তারা মনে করত দেহ হলো আত্মাকে ধরে রাখার সাময়িক একটি বাহন, তাই চূড়ান্ত
মুক্তির জন্য কাল্টের ৩৯ জন সদস্য ক্যালিফোর্নিয়ার একটি প্রাসাদে বিষ খেয়ে
আত্মহত্যা করে। তাদের মধ্যে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে কাল্টের সব সদস্যদের একই
ধরনের কালো পোশাক ও নাইকি ব্রান্ডের জুতা পরিহিত অবস্থায় মৃতদেহ উদ্ধার করা
হয়।
হেভেনস্ গেইটের এই পরিনতি বিশ্বজুড়ে শোক ও বিস্ময়ের জন্ম দেয় এবং এটি কাল্টের
প্রভাব নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে। এই কাল্টের পরিনতি দেখিয়েছে
কীভাবে যুক্তিহীন বিশ্বাস একটি বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সহজেই গভীরভাবে গেঁথে
যেতে পারে। ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ত্ব, বিচ্ছিন্নতা ও গোষ্ঠী চিন্তার বিপজ্জনক
পরিনতির প্রতীক হয়ে এই ঘটনা ইতিহাসে একটি করুন সতর্কতা হিসেবে রয়ে
গেছে।
ওম শিনরিকিও
১৯৯৫ সালে জাপানে এক ভয়াবহ হামলা ঘটে যেখানে ওম শিনরিকিও নামের একটি কাল্ট
টোকিওর একটি লোকভর্তি পাতাল ট্রেনে প্রাণঘাতী স্যারিন গ্যাস ছেড়ে দেয়। ঐ হামলায়
১৩ জন নিহত হন এবং হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হন, যার ফলে পুরো শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে
পড়ে। এটি জাপানের ইতিহাসে অন্যতম ভয়ংকর একটি অভ্যন্তরীন সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে
বিবেচিত হয়ে থাকে।
এই কাল্টের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শোকো আসাহারা, যিনি নিজেকে বিভিন্ন ধর্মীয় দেবতার
অবতার বলে দাবি করতেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্ম, হিন্দু ধর্ম এবং প্রলয় ভিত্তিক
খ্রিস্ট্রীয় বিশ্বাসের মিশ্রনে একটি বিকৃত ধর্মতত্ত্ব গঠন করেন। আসাহারা তার
অনুসারীদের আধ্যাত্মিক মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেন, সেইসঙ্গে আবার এক আসন্ন
বৈশ্বিক বিপর্যয়ের ভবিষ্যতবানীও করেন।
আসাহারার নের্তৃত্ত্বে এই কাল্টটি ক্রমেই গোপনীয় ও সশস্ত্র হয়ে ওঠে। তারা গোপনে
প্রাণঘাতী রাসায়নিক অস্ত্র সংগ্রহ করে, বিভিন্ন রকম পরীক্ষা চালায় এবং আরও
প্রাণঘাতী অস্ত্র উৎপাদন করার জন্য উচ্চশিক্ষিত বিজ্ঞানীসহ দক্ষ লোকেদের নিয়োগ
করে। আসাহারা বিশ্বাস করতেন যে পৃথিবীকে বিশুদ্ধ করার জন্য সহিংসতার কোন বিকল্প
নেই।
টোকিও সাবওয়েতে হামলাটি পরিকল্পিতভাবে চালানো হয়। কাল্ট সদস্যরা ব্যস্ত সময়ে
ট্রেনে স্যারিন গ্যাস ছেড়ে দেবার ফলে হঠাৎ করেই অনেক যাত্রীর শ্বাসকষ্ট দেখা
দেয়, তারা খিঁচুনি দিতে দিতে অজ্ঞান হয় পড়েন, তাদের মুখ থেকে ফেনা বের হতে থাকে
এবং সবশেষে অনেকেই মারা যান; জরুরী সেবাদাতা সংস্থাগুলো যাত্রীদের চিকিৎসা দিতে
গিয়ে হিমশিম খেতে থাকে। এই ভয়াবহ দৃশ্য প্রমান করে ওম শিনরিকিও কাল্টের বৃহৎ
পরিসরে সহিংসতা চালানোর ব্যাপক সক্ষমতা ছিল।
কিভাবে উগ্র বিশ্বাস, ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব এবং অন্ধ আনুগত্য একসাথে মিলে চরম
পরিনতি ডেকে আনতে পারে তা এই ট্রাজেডি আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
আসাহারা ধর্মীয় চিন্তাকে বিকৃতভাবে ব্যবহার করে সন্ত্রাসবাদের যুক্তি দাঁড়
করান, যা জাপানিজ সমাজে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। ধর্মীয় উন্মাদনা ভুল পথে
পরিচালিত হলে তা কতটা ধ্বংসাত্বক হতে পারে, এই ঘটনা তা আমাদের আজও স্মরন করিয়ে
দেয়।
NXIVM
NXIVM ছিল একটি আধুনিক কাল্ট, যা বাহ্যিকভাবে নিজেকে আত্ম-উন্নয়ন ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপস্থাপন করত। তারা কর্মশালা ও সেমিনারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত উন্নয়ন, নেতৃত্বগুণ তৈরি এবং মানসিক শক্তি বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিত। সুসজ্জিত প্রচারণা, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সমর্থন এবং পেশাদার পরিবেশের কারণে অনেকেই এতে আকৃষ্ট হন এবং সদস্যপদ গ্রহণ করেন।এই সংগঠনটির নেতৃত্বে ছিলেন কিথ রানিয়েরে (Keith Raniere), যিনি নিজেকে ‘জীবন প্রশিক্ষক’ বা life coach এবং অসাধারণ প্রতিভাধর পরামর্শদাতা হিসেবে প্রচার করতেন। NXIVM-এর ভেতরে তিনি একটি কঠোর শ্রেণিবিন্যাস চালু করেন, যেখানে সদস্যদের তার প্রতি আনুগত্য ও নিঃশর্ত অনুসরণের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই কাঠামো এক ভয়াবহ কর্তৃত্ববাদী ও শোষণমূলক রূপ নেয়, যেখানে মানসিক ও শারীরিকভাবে অনেক সদস্যকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
২০১৮ সালে NXIVM-এর চকচকে বাহ্যিক রূপের আড়ালে লুকানো অন্ধকার সত্য প্রকাশ পায়।
তদন্তে জানা যায়, নেতা কিথ রানিয়েরে সংগঠনের ভেতরে ডিওএস (DOS) নামের একটি
গোপন উপদল তৈরি করেছিলেন। এখানে নারী সদস্যদের শরীরে আগুনের ছ্যাঁকা দিয়ে
তার নামের আদ্যক্ষর বসানো হতো। তাদের ব্যক্তিগত ও আপত্তিকর তথ্য দিয়ে
ব্ল্যাকমেইল করা হতো এবং ‘মেন্টরশিপ’-এর নামে যৌন কাজে বাধ্য করা
হতো।
এই ব্রান্ডিং ও নিপীড়নকে বিশ্বাস, শৃঙ্খলা এবং আত্মউন্নয়নের চর্চা হিসেবে
উপস্থাপন করা হতো; এর ফলে সংগঠনটিতে মানসিক নিয়ন্ত্রন ও জবরদস্তির মধ্যকার সীমা
ঘোলাটে হয়ে ওঠে। কাল্টের অনেক নারী সদস্য মানসিকভাবে এতই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে
তারা এসব অপমানজনক আচরনকে নিজেদের বিকাশের অংশ বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেন।
রানিয়েরে ও তার অনুসারীরা উন্নয়ন, থেরাপি ও ক্ষমতায়নের ভাষা ব্যবহার করে এসব
ক্ষতিকর কাজকে যৌক্তিক বলে চালানোর চেষ্টা করতেন।
NXIVM এর পতন আমাদেরকে দেখিয়ে দেয় কীভাবে অসৎ কিন্ত ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিরা
আধুনিক ও প্রগতিশীল ভাষা ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে। ঐতিহ্যবাহী
কাল্টগুলোর মত নিজেকে প্রকাশ না করে, এটি কর্পোরেট ও থেরাপিউটিক মুখোশে নিজেকে
লুকিয়ে রেখেছিল, যার ফলে একে চিহ্নিত করা আরও কঠিন ছিল। এই ঘটনা আমাদেরকে মনে
করিয়ে দেয় যে আধুনিক ও প্রগতিশীল বলে মনে হওয়া যেকোন সংগঠনও গোপনে এক ভয়াবহ
কাল্টে পরিনত হতে পারে।
কাল্টরা যেভাবে তাদের সদস্যদের ব্রেইন ওয়াশ করে
কাল্টগুলো সাধারণত তাদের প্রকৃত রূপ স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে সদস্য সংগ্রহ করে না।
এই নিয়োগ প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে এবং মানুষকে ধোঁকা দিয়ে চলে। এতে করে তারা প্রথমে
মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে, তারপর ধীরে ধীরে তাদের গভীর ও প্রায়শই বিপজ্জনক
বিশ্বাস এবং কর্মকান্ড সামনে নিয়ে আসে।
দুর্বল অবস্থানে থাকা ব্যক্তিদের টার্গেট করা
আর্থিক সংকটে ভোগা শিক্ষার্থী, সদ্য তালাকপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং স্বজন হারানো
শোকাহত মানুষদের প্রায়ই কাল্টের টার্গেট বানানো হয়ে থাকে। এসব ব্যক্তিরা সাধারণত
সমাজে তাদের জায়গা খুঁজে নিতে চাইছেন, তাদের জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজছেন বা তারা
মানসিক প্রশান্তি চান। কাল্টগুলো এই মানবিক চাহিদাগুলোকে কাজে লাগিয়ে তাদের
সদস্যদের নিরাপত্তা, উদ্দেশ্য এবং সুস্থতার প্রতিশ্রুতি দেয়।
ভালোবাসার বৃষ্টি (Love Bombing)
কাল্টের নতুন সদস্যদের উপর প্রশংসা ও ভালবাসার বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়, যাতে তারা
নিজেদেরকে মূল্যবান এবং গ্রহণযোগ্য মনে করে। কাল্টের নতুন সদস্যদের অতিরিক্ত
মনযোগ দেওয়া, তাদেরকে শারীরিক স্নেহ (যেমন, হাত ধরা, আলিঙ্গন করা, বা আলতো করে
মাথায় হাত বুলানো) প্রদর্শন করা, এবং তাদের চিন্তা ভাবনাকে ইতিবাচকভাবে উৎসাহিত
করার মাধ্যমে কাল্টের সাথে তাদের এক ধরনের গভীর সংযোগ তৈরি করা হয়। এই আবেগঘন
বন্ধনে জড়িয়ে পড়ার ফলে সদস্যদের জন্যে কাল্টের বিপজ্জনক লক্ষণগুলো চিনতে পারা
কিংবা কাল্ট ছেড়ে চলে যাওয়াকে কঠিন করে তোলে।
ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন করা
সময়ের সাথে সাথে কাল্টের সদস্যদের পরিবার ও বন্ধুদের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক
ছিন্ন করতে উৎসাহিত বা বাধ্য করা হয়। এভাবে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার
ফলে তারা তাদের সংগঠনকে নিয়ে বাইরের লোকেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত থেকে
বঞ্চিত হয়। এর ফলে কাল্টের প্রতি সদস্যদের নির্ভরশীলতা আরও বেড়ে যায়।
ধাপে ধাপে মতাদর্শে দীক্ষিত করা
নতুন সদস্যদের সামনে কাল্টের বিশ্বাসগুলোকে শুরুতে নিরীহভাবে উপস্থাপন করা হয়ে
থাকে, তারপর তাদেরকে ধীরে ধীরে চরমপন্থায় নিয়ে যাওয়া হয়। সদস্যদের কাল্টের
বিশ্বাস ও নের্তৃত্ব নিয়ে সন্দেহ দমন করতে শেখানো হয়, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করার
জন্য সদস্যদের কাল্টের নিজস্ব শব্দভান্ডার ব্যবহার করতে বলা হয়, এবং তাদেরকে
নির্দিষ্ট আচরনবিধি মেনে চলতে বাধ্য করা হয়। কাল্টকে নিয়ে প্রশ্ন করাকে দুর্বলতা
বা বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখানো হয়।
অর্থনৈতিক ও মানসিক নির্ভরশীলতা তৈরি করা
কাল্টের সদস্যদের ব্যক্তিগত সম্পদ ত্যাগ করতে, বিনা পারিশ্রমিকে কাল্টের জন্য কাজ
করতে অথবা একসাথে বসবাস করতে বলা হয়। এসব কাজ সদস্যদেরকে আর্থিক ও মানসিকভাবে
কাল্টের সাথে আরও বেশি জড়িয়ে ফেলে। ফলে তাদের জন্য কাল্ট ছেড়ে চলে যাওয়াটা প্রায়
অসম্ভব হয়ে পড়ে।
ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে কাল্টের প্রভাব
মানসিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে কাল্টগুলোর প্রভাব গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী
হতে পারে। অনেক সময় ব্যক্তি ও পরিবার কাল্ট থেকে মুক্ত হবার অনেক পড়েও এর
কষ্টদায়ক পরিনতির শিকার হন। এই ক্ষতি মানসিক স্বাস্থ্য, পারিবারিক সম্পর্ক,
অর্থনৈতিক অবস্থা এবং এমনকি জননিরাপত্তার উপরও প্রভাব ফেলে।
মানসিক আঘাত
কাল্ট ছেড়ে আসার পরে অনেকের মধ্যেই পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (PTSD),
হতাশা এবং উদ্বেগ দেখা দেয়। সাবেক সদস্যরা অপরাধবোধ, বিভ্রান্তি এবং স্থায়ী ভয়ের
মতো মানসিক সমস্যায় ভোগেন। আত্মপরিচয় পুনর্গঠন ও মানসিক শোষণের ক্ষতি
কাটিয়ে ওঠার জন্য অনেক সময় পেশাদার সহায়তা ও দীর্ঘমেয়াদি থেরাপির প্রয়োজন
হয়।
পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা
কাল্টগুলি প্রায়ই সদস্যদের তাদের অবিশ্বাসী আত্মীয়স্বজনদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন
করতে বলে। এর ফলে কাল্টের সদস্যদের তাদের পরিবারের লোকজনদের সাথে গভীর দূরত্ব ও
হৃদয়বিদারক বিচ্ছেদ সৃষ্টি হয়। অনেক পরিবার বিপুল টাকাপয়সা খরচ করে তাদের
প্রিয়জনকে কাল্ট থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে বা তাদের সাথে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপনের
চেষ্টা করে।
আর্থিক ক্ষতি
সদস্যরা প্রায়ই তাদের সঞ্চয়, সম্পত্তি এবং আয় কাল্টকে দিয়ে দেয়। অনেক সময় তাদেরকে
বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে বা তাদের নিজস্ব পেশা ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়ে থাকে।
কাল্ট ত্যাগ করার পরে অনেকেই তাই আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়েন এবং কোনো রকম আর্থিক
সহায়তা ছাড়াই তাদেরকে নতুন করে জীবন শুরু করতে হয়।
জননিরাপত্তার ঝুঁকি
কিছু কাল্ট সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ, মানব পাচার এবং প্রতারনার মতো অপরাধূলক
কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। এসব কার্যকলাপ শুধু সদস্যদের জন্যেই নয়, বরং গোটা সমাজের
জন্যই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জন্য এমন গোষ্ঠীগুলো
চিহ্নিত ও বিলুপ্ত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
কাল্ট নিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিক্রিয়া
উন্নত বিশ্বে সরকার, গনমাধ্যম এবং মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীরা বিভিন্ন উপায়ে
কাল্ট সমস্যা মোকাবেলা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এসব প্রচেষ্টায় প্রায়ই নৈতিক ও
আইনি জটিলতা দেখা যায়। মানুষের বিশ্বাসের স্বাধীনতা রক্ষা করা এবং একইসাথে
তাদেরকে শোষিত হওয়া ও প্রতারনার শিকার হওয়া থেকে বাঁচানোর প্রয়োজনের মধ্যে
ভারসাম্য বজায় রাখা তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইনি ব্যবস্থা
অনেক গনতান্ত্রিক দেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা কাল্ট ভাঙার প্রচেষ্ঠাকে জটিল করে তোলে।
সেসব দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন কোন অপরাধ সংঘঠিত হবে কেবল তখনই নাগরিকদের
জীবনে হস্তক্ষেপ করতে পারবে। তবে ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশগুলো সন্দেহভাজন
কাল্ট গোষ্টিগুলোর উপর সরকারি সংস্থার মাধ্যমে সক্রিয় নজরদারি চালায়।
ডিপ্রোগ্রামিং এবং স্বেচ্ছায় প্রস্থান করা
এক সময় কাল্টের সদস্যদের জোর করে কাল্ট থেকে সরিয়ে এনে তাদেরকে ডিপ্রোগ্রামিং এর
মাধ্যমে মানসিকভাবে পুনঃশিক্ষিত করা হতো। কিন্তু বর্তমানে মানবাধিকার ও সম্মতির
বিষয় নিয়ে ঝামেলা হবার কারনে এই পদ্ধতির ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে। আজকাল তাই উন্নত
বিশ্বে সদস্যদের কাল্ট থেকে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে যাবার জন্য কাউন্সিলিং এবং সরকারী
সহায়তা সংস্থাগুলো থেকে সাপোর্ট নেওয়াকে অধিক মানবিক ও কার্যকর বিকল্প হিসেবে
দেখা হচ্ছে।
শিক্ষা ও সচেতনতা
শিক্ষা ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম মানুষকে কাল্টে যোগদানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে
তুলতে সাহায্য করে। সমালোচোনামূলক চিন্তাভাবনা, মানসিক প্রভাব ও সহচরদের চাপের
বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যপারে স্কুল্ভিত্তিক কর্মসূচিগুলো
বিশেষভাবে কার্যকর বলে একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে। কাল্টের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে
প্রামান্যচিত্র বা ডকুমেন্টারি তৈরি, বই লেখা এবং কাল্ট থেকে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে
যাওয়া ব্যক্তিদের সাক্ষাতকার প্রচার করা কাল্টের গতিবিধি সম্পর্কে সমাজকে সচেতন
করে।
ইন্টারনেটের ভূমিকা
ইন্টারনেট কাল্টদের জন্য তাদের বার্তা ছড়ানো, অনলাইনে ঘেরাটোপ তৈরি করে তাদের
সদস্য নিয়োগ করার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। তবে, একই সাথে এটি কাল্ট থেকে
বেঁচে ফেরা সদস্যদের একত্রিত হওয়া, তথ্য ভাগাভাগি করা এবং কাল্টের ভিতরে চলা
শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের প্রমান প্রকাশ করার সুযোগও করে দিয়েছে। Reddit এর
r/excult এর মতো অনলাইন কমিউনিটি এবং International Cultic Studies Association
(ICSA) এর মতো সংগঠন কাল্ট নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও সহায়তা প্রদান করে
থাকে।
শেষ কথা
কাল্ট বা গোপন ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো মানুষের কিছু গভীর চাহিদা পূরণ করে যেমন, একটা
সম্প্রদায়ের অংশ হওয়া, জীবনে উদ্দেশ্য খোঁজা, নিশ্চিততা পাওয়া এবং কোথাও
অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অনুভূতি। কিন্তু যখন কর্তৃত্ববাদী নেতারা এসব চাহিদার সুযোগ
নেয়, তখন তা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। তারা যে মানসিক কৌশলগুলো ব্যবহার করে,
তা অনেক সময় এতটাই সূক্ষ্ম ও শক্তিশালী হয় যে, বুদ্ধিমান ও শিক্ষিত মানুষরাও সহজে
প্রভাবিত হয়ে পড়ে।
এই ধরনের গোষ্ঠীর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের একটি সচেতন ও ভারসাম্যপূর্ণ পথ নিতে হয়; যেখানে একদিকে মানুষের বিশ্বাসের স্বাধীনতা রক্ষা করা হয়, আবার অন্যদিকে দুর্বল ও প্রভাবিত মানুষদেরও নিরাপত্তা দেওয়া হয়। শিক্ষা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং মুক্ত আলোচনা সমাজকে এই ধরনের গোষ্ঠীর নেতিবাচক প্রভাব থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারে এবং যারা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করতে পারে।
এই ধরনের গোষ্ঠীর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের একটি সচেতন ও ভারসাম্যপূর্ণ পথ নিতে হয়; যেখানে একদিকে মানুষের বিশ্বাসের স্বাধীনতা রক্ষা করা হয়, আবার অন্যদিকে দুর্বল ও প্রভাবিত মানুষদেরও নিরাপত্তা দেওয়া হয়। শিক্ষা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং মুক্ত আলোচনা সমাজকে এই ধরনের গোষ্ঠীর নেতিবাচক প্রভাব থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারে এবং যারা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করতে পারে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url