নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতাঃ মৃত্যুর কাছাকাছি অবস্থায় মানুষ যা দেখতে পায়
মৃত্যু হলো মানব জীবনের সবচেয়ে বড় রহস্য। প্রতিটি সংস্কৃতি, ধর্ম এবং দর্শনই শেষ নিঃশ্বাসের পর আমাদের আত্মার সাথে কী হয় তা ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছে । কিন্তু এত চেষ্টার পরও এই প্রশ্নের উত্তর আজও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। জীবন ও মৃত্যুর সীমারেখাকে ঘিরে সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি হলো নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা (Near-Death Experience বা NDE)। এটি হলো কিছু গভীর মানসিক এবং কখনও কখনও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার সমষ্টি। সাধারণত, যারা মৃত্যুর খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন অথবা ক্লিনিক্যালি মৃত ঘোষণার পর আবার বেঁচে উঠেছেন, তারাই এই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন।
কেউ কেউ নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা (NDE)-কে পরকালীন জীবনের বা মৃত্যুর পরের জীবনের
প্রমাণ হিসেবে দেখেন। অন্যদিকে, অনেক বিশেষজ্ঞরা এটিকে গুরুতর ট্রমা বা মানসিক
আঘাতের কারণে মস্তিষ্কে সৃষ্টি হওয়া স্নায়ুবৈজ্ঞানিক (neurobiological)
অথবা মনস্তাত্ত্বিক (psychological) প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।
নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা-কে যেভাবেই ব্যাখ্যা করাই হোক না কেন, এটি মানুষের চেতনা
(consciousness), আধ্যাত্মিকতা এবং বৈজ্ঞানিক উপলব্ধির সীমারেখা সম্পর্কে
আমাদেরকে এক অনন্য অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।
সূচীপত্রঃ নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতাঃ মৃত্যুর কাছাকাছি অবস্থায় মানুষ যা দেখতে পায়
- নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার ধরন
- নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার কিছু সাধারন বৈশিষ্ট্য
- নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা নিয়ে বিভিন্ন সংস্কৃতির দৃষ্টিভঙ্গি
- নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
- নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা নিয়ে চলমান বিতর্ক
- নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার মনস্তাত্ত্বিক এবং আধ্যাত্বিক প্রভাব
- নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা নিয়ে গবেষনা করার সীমাবদ্ধতা
- নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা নিয়ে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
- শেষ কথা
নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার ধরন
নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা (NDE) হলো এক ধরনের ব্যক্তিগত ঘটনা, যা সাধারণত মানুষের
মৃত্যুর খুব কাছাকাছি অবস্থায় ঘটে থাকে। এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হৃদযন্ত্রের
ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া (cardiac arrest), গুরুতর আঘাত কিংবা চরম শারীরিক
বিপদের সময়ে দেখা যায়। যেসব মানুষ এমন পরিস্থিতি থেকে বেঁচে ফেরেন, তারা
প্রায়শই এই মুহূর্তগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন যে এটি ছিল এক জীবন্ত এবং
রূপান্তরমূলক অভিজ্ঞতা। অনেকেই দাবি করেন যে তাদের কাছে এই অভিজ্ঞতাকে সাধারণ
জীবনের চেয়েও বেশি বাস্তব ও শক্তিশালী মনে হয়েছিল।
এই ধরনের অভিজ্ঞতাকে প্রায়শই অবর্ণনীয় বলা হয়, অর্থাৎ এগুলোকে পুরোপুরি
ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন বা একরকম অসম্ভবই বলা চলে। তা সত্ত্বেও, যাঁরা এই
অভিজ্ঞতা লাভ করেন, তাঁরা বলেন যে ঐ সময়ের ঘটনাগুলি তাঁদের জন্য গভীর ব্যক্তিগত
তাৎপর্য বহন করে। অনেকের ক্ষেত্রে, এই অভিজ্ঞতার স্মৃতি বহু বছর ধরে স্পষ্ট ও অটল
থেকে যায়।
নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার বৈশিষ্ট্যগুলি একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হতে পারে, তবে
তাদের মধ্যে প্রায়শই কিছু সাধারণ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এগুলো হলোঃ
- শরীরের বাইরে ভেসে ওঠা (অর্থাৎ নিজেকে বাইরে থেকে দেখা) [Out of body experience]
- একটি সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়া
- উজ্জ্বল আলো দেখা
- অথবা, মৃত প্রিয়জনদের সাথে সাক্ষাৎ হওয়া।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
রেমন্ড মুডি
এই "নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা" (NDE) শব্দগুচ্ছটি জনসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় করে
তোলেন। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত তাঁর Life After Life নামের বইয়ে তিনি একশ'রও
বেশি মানুষের সাক্ষাৎকার নেন, যাঁদেরকে ক্লিনিক্যালি মৃত ঘোষণা করার পর আবার
জীবিত করা হয়েছিল। এই গবেষণার মাধ্যমে তিনি এমন কিছু অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্ত ধারা
বা মিল খুঁজে পান, যা একটি যৌথ মানসিক বা আধ্যাত্মিক উপাদানের ইঙ্গিত দেয়।
মুডি-র এই গবেষনা নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা নিয়ে চিকিৎসা, মনোবিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিক
অনুসন্ধানের ভিত্তি তৈরি করে দেয়। যেসব অভিজ্ঞতাকে একসময় কেবলই অস্পষ্ট কাহিনী
বলে উড়িয়ে দেওয়া হতো, তা এখন গুরুত্বপূর্ণ গবেষনা এবং আলোচনার বিষয়ে পরিনত
হয়েছে। সেই থেকে, নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা সারা বিশ্বে মানুষের কৌতূহল জাগিয়ে
তুলেছে এবং এটি বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করেছে।
নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার কিছু সাধারন বৈশিষ্ট্য
সাংস্কৃতিক এবং ব্যক্তিগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার
ভুক্তভোগীরা প্রায়শই কিছু বৈশিষ্ট্য বারবার উল্লেখ করে থাকেন। যদিও এই
উপাদানগুলোর তীব্রতা ও ক্রম একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হতে পারে, তবুও বিভিন্ন
সংস্কৃতিতে এদের মধ্যে যে মিল দেখা যায়, তা নির্দেশ করে যে মানুষেরা যখন মৃত্যুর
সীমানায় পৌঁছায়, তখন তাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ
দিক থাকে। এগুলো হলোঃ
শরীরের বাইরে অভিজ্ঞতা (Out of body experience)ঃ অনেকেই বর্ণনা করেন যে তাঁরা তাঁদের শরীরের উপরে ভেসে ছিলেন, এবং সেখান
থেকে ডাক্তার, নার্স বা আশেপাশের লোকজনকে তাঁদেরকে বাঁচানোর বা পুনরুজ্জীবনের
চেষ্টা করতে দেখেছেন। এই অভিজ্ঞতাগুলো প্রায়শই একধরনের অদ্ভুত বিচ্ছিন্নতার সাথে
ঘটে, যেন তাঁরা একইসাথে সেখানে থেকেও না থাকার অনুভূতি পান। তারপরেও এই
অভিজ্ঞতাগুলোকে তাঁদের কাছে অত্যন্ত জীবন্ত এবং সন্দেহাতীতভাবে বাস্তব বলে মনে
হয়।
শান্তি ও উচ্ছ্বাসের অনুভূতিঃ নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো ভুক্তভোগীর গভীর
প্রশান্তি অনুভব করা। এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাওয়া ব্যাক্তিরা জানান যে সেই
সময়ে তারা ব্যথা, ভয় এবং অস্থিরতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্তিলাভ করেন। এর পরিবর্তে
তারা এক ধরনের অপ্রতিরোধ্য ভালোবাসা, নিরাপত্তা ও গ্রহণযোগ্যতার অনুভূতি পান।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, যখন তাঁদের শরীর চরম আঘাত বা প্রায়-মারাত্মক
পরিস্থিতির মধ্যে থাকে, তখনও এই ইতিবাচক আবেগগুলো অনুভূত হয়।
সুড়ঙ্গ এবং আলোঃ নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার সবচেয়ে পরিচিত মোটিফগুলির একটি হলো অন্ধকার
সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে এক উজ্জ্বল আলোর দিকে এগিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা। এই আলোকে
সাধারণত উষ্ণ, ভালোবাসাপূর্ণ এবং প্রায় সচেতন উপস্থিতি হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে
থাকে। যাঁদের এই অভিজ্ঞতা হয়, তাঁদের অনেকের কাছে এই মুহূর্তটিই নিকট-মৃত্যু
ঘটনার সবচেয়ে কেন্দ্রীয় ও স্মরণীয় অংশ হয়ে ওঠে।
নিজের জীবন পর্যালোচনাঃ কিছু অভিজ্ঞতাকারীরা জানান যে মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে তাঁরা জীবনের এক
প্যানোরামিক পুনরাবৃত্তি অনুভব করেন, যেখানে তাঁদের জীবনের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত
অথচ বিশদভাবে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নিজেদের জীবনের পর্যালোচনার সময়ে তাঁরা শুধু
নিজেদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোই দেখেন না, বরং তাঁদের কাজের দ্বারা
অন্যদের ওপর কী প্রভাব পড়েছিল, সেই অনুভূতিগুলোও উপলব্ধি করেন।
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা ব্যাক্তিরা এই প্রক্রিয়াকে তাদের জীবনের জন্য রুপান্তর
মূলক এক অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখে থাকেন, যার মধ্যে তারা নিজের জন্য নৈতিক বা
আধ্যাত্মিক শিক্ষা খুঁজে পান।
সত্তার সাথে সাক্ষাৎঃ অনেক মানুষ মৃত আত্মীয়-স্বজন, আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক বা রহস্যময় সত্তার
সাথে সাক্ষাতের কথা বলেন। আবার অনেকে দাবী করেন যে এই সত্তাগুলো প্রায়শই
টেলিপ্যাথির (মনের মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগ) সাহায্যে যোগাযোগ করে এবং তাদেরকে
আশ্বাস, দিকনির্দেশনা বা সান্ত্বনা প্রদান করে। এই ধরনের সাক্ষাৎ প্রায়শই
তাঁদের মনে গভীর ছাপ ফেলে যায়, যা তাদেরকে শারীরিক অস্তিত্বের বাইরের
অতিপ্রাকৃতিক সংযোগের প্রতি তাঁদের বিশ্বাসকে আরও মজবুত করে।
ফিরে আসার অনিচ্ছাঃ নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার একটি সাধারণ থিম হলো অভিজ্ঞতাকারীদের এমন এক
সীমান্ত বা বাধার অনুভূতি হওয়া যার ওপার থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। এই সময়ে
অভিজ্ঞতাকারীরা হয় শুনতে পান, নয়তো নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেন যে এই পৃথিবীতে ফিরে
আসার সময় এখনও হয়নি। এই উপলব্ধির পরেই সাধারণত তাঁদের হঠাৎ করে জীবনে ফেরা হয়,
যদিও অনেক সময় এটি নিয়ে তাঁদের মধ্যে অনিচ্ছা বা হতাশা কাজ করে।
তীক্ষ্ণ ইন্দ্রিয় ও সময়বোধের পরিবর্তনঃ অনেক নিকট-মৃত্যু
অভিজ্ঞতার বর্ণনায় অসাধারণ ইন্দ্রিয়গত সচেতনতার কথা বলা হয়। এই অভিজ্ঞতা
চলাকালীন সময়ে ব্যাক্তিরা তাদের চারপাশের বস্তুর রংগুলোকে আরও উজ্জ্বল ভাবে দেখতে
পায় এবং তাদের আশেপাশের শব্দগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সময়কে প্রায়শই হয় খুব
ধীরে চলতে থাকা, অথবা অনন্তভাবে প্রসারিত হওয়া, কিংবা পুরোপুরি বিলীন হয়ে
যাওয়া হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এই পরিবর্তিত উপলব্ধির কারণে অভিজ্ঞতাটিকে মনে হয়
যেন এটি সাধারণ বাস্তবতার বাইরের এক জগতে ঘটছে।
নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা নিয়ে বিভিন্ন সংস্কৃতির দৃষ্টিভঙ্গি
নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা শুধু পশ্চিমা সমাজের প্রেক্ষাপটে সীমাবদ্ধ নয়। বিভিন্ন
সংস্কৃতির মানুষ যখন এই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন, তখন যেমন তাঁদের অভিজ্ঞতাগুলোর
মধ্যে আশ্চর্যজনক মিল পাওয়া যায়, তেমনি তাঁদের বর্ণনায় নিজস্ব সাংস্কৃতিক
ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিভঙ্গিও প্রতিফলিত হয়। এর থেকে বোঝা যায় যে, মৌলিক অভিজ্ঞতাটি
এক হলেও, সংস্কৃতি ভেদে তার প্রকাশের ধরন বদলে যায়।
পাশ্চাত্য সমাজে, যেখানে খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, সেখানে
নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার বর্ণনায় প্রায়ই যিশু, দেবদূত (ফেরেশতা) বা স্বর্গীয়
সত্তার সাথে সাক্ষাতের কথা শোনা যায়। অনেকেই উজ্জ্বল আলো এবং শান্তি ও ঐশ্বরিক
ভালোবাসায় ভরা স্বর্গের মতো দৃশ্যের কথা বলেন। এই ধরনের দর্শনগুলোকে প্রায়শই
খ্রিস্টীয় বিশ্বাস অনুসারে স্বর্গ ও পরিত্রাণের (Salvation) প্রমাণ হিসেবে
ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে।
হিন্দু সংস্কৃতিতে, নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার বর্ণনায় কখনও কখনও ভুক্তভোগীদের
মৃত্যুর দেবতা যমের দূত বা সহকারীদের সাথে সাক্ষাতের কথা শোনা যায়। অনেক
ক্ষেত্রে, এই সত্তারা জানান যে ব্যক্তির আত্মাকে ভুলবশত পরকালে নিয়ে আসা হয়েছে
এবং তাকে নিজের জীবনে ফিরে যেতে হবে। এই ধরনের অভিজ্ঞতাগুলো মূলত হিন্দু ধর্মের
কর্মফল (Karma), পুনর্জন্ম (Reincarnation) এবং ঈশ্বরীয় ন্যায়বিচারের ধারণাকে
প্রতিফলিত করে।
বৌদ্ধ ঐতিহ্যে, নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা প্রায়শই তিব্বতি মৃতদের বই (Tibetan Book of the Dead)-এ বর্ণিত আধ্যাত্মিক যাত্রার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে থাকে। এই অভিজ্ঞতার সময়
অভিজ্ঞতাকারীরা একটি আলোকিত জগতে প্রবেশ করতে পারেন অথবা এমন সব জিনিস দেখতে
পারেন যা তাঁদের নিজস্ব চেতনা ও পূর্বজন্মের কর্মের (Karma) প্রতিফলন ঘটায়।
বৌদ্ধধর্মে এসব ঘটনাকে প্রায়শই জ্ঞানলাভ (Enlightenment) বা পুনর্জন্মের চক্র
(Samsara) থেকে মুক্তির সুযোগ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।
অনেক আদিবাসী সংস্কৃতিতে, নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতায় প্রকৃতির আত্মা, পূর্বপুরুষ বা
রক্ষাকারী সত্তার সাথে অভিজ্ঞতাকারীদের সরাসরি সাক্ষাতের কথা বলা হয়। ভুক্তভোগী
ব্যক্তিরা প্রায়শই নদী, পর্বত বা বন অতিক্রম করার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন, যা
তাদের কাছে ইহকাল এবং পরকালের মধ্যবর্তী সীমানার প্রতীক হিসেবে রূপ ধারন করে আসে।
এই ধরনের আধ্যাত্মিক যাত্রা প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখা এবং
পূর্বপুরুষদের জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে আরও দৃঢ়
করে।
নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
অনেকে নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতাকে পরকাল বা মৃত্যুর পরের জীবনের এক ঝলক বলে মনে
করলেও, আধুনিক বিজ্ঞান মানুষের মস্তিষ্ক ও শরীরের ভেতরের চলমান প্রক্রিয়াগুলোর
মধ্যে এই রহস্যের ব্যাখ্যা খোঁজে। এই ঘটনাটিকে ব্যাখ্যা করার জন্য বেশ কয়েকটি
বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলো হলোঃ
নিউরোলজিকাল তত্ত্বগুলোঃ
- হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে গেলে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব (অ্যানোক্সিয়া) দেখা দেয়। এর ফলে রোগীর মনে হ্যালুসিনেশন, সুড়ঙ্গ-দৃষ্টি (Tunnel Vision) এবং উচ্ছ্বাসের (Euphoria)-এর মতো অনুভূতি তৈরি হতে পারে। যখন মস্তিষ্ক অক্সিজেন থেকে বঞ্চিত হয়, তখন সেখানকার নিউরনগুলো (স্নায়ুকোষ) অনিয়মিতভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে, যা তীব্র ইন্দ্রিয় বিভ্রম ঘটায়। মস্তিষ্কের এই পরিবর্তিত ক্রিয়াই একজন মানুষকে আলোর ঝলক, সুড়ঙ্গ বা বিভিন্ন অবাস্তব জিনিসকে বাস্তব মনে হওয়া অনুভূতির অভিজ্ঞতা দিতে পারে।
- আঘাত বা ট্রমার সময় রক্তে এন্ডরফিন নিঃসরণ হয়, যা নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতায় অনুভূত শান্তি ও স্বস্তির অনুভূতিকে ব্যাখ্যা করতে পারে। এন্ডরফিন হলো এক ধরনের হরমোন যা শরীরের প্রাকৃতিক ব্যথানাশক হিসেবে কাজ করে। এটি চরম পরিস্থিতিতে ভয় ও চাপ কমাতে সাহায্য করে। শরীরে এই রাসায়নিকের নিঃসরণ হঠাৎ বেড়ে যাওয়া মানুষের মনে (এমনকি যখন কেউ মৃত্যুর মুখোমুখি হন তখনও) উষ্ণতা, গভীর প্রশান্তি এবং বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে।
- টেম্পোরাল লোব (Temporal Lobe) হচ্ছে মস্তিষ্কের এমন একটি অংশ, যা স্মৃতি গঠন, পাঁচ ইন্দ্রিয় থেকে পাওয়া তথ্যের প্রক্রিয়াকরণ এবং আধ্যাত্মিক উপলব্ধি তৈরি করার সাথে জড়িত থাকে। যখন মস্তিষ্ক কোনো চরম চাপের মধ্যে থাকে, তখন মস্তিস্কের এই অংশে অস্বাভাবিক কার্যকলাপ শুরু হতে পারে। এই অস্বাভাবিকতা শরীরের বাইরে ভেসে ওঠা বা মৃত প্রিয়জনের সাথে সাক্ষাতের মতো জটিল বিভ্রম বা হ্যালুসিনেশন সৃষ্টি করতে পারে।
মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্বগুলোঃ
- নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা মানুষের মনের একটি প্রতিরক্ষা প্রক্রিয়া (Defense Mechanism) হিসেবেও কাজ করতে পারে। এক্ষেত্রে, মস্তিষ্ক ব্যক্তিকে মৃত্যুর ভয় থেকে রক্ষা করার জন্য কিছু সান্ত্বনাদায়ক দৃশ্য তৈরি করে। এই মানসিক প্রতিক্রিয়া চরম চাপের মুহূর্তে ব্যাক্তির মনে শান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং নিকট-মৃত্যু পরিস্থিতিতে ব্যক্তিকে একধরনের নিয়ন্ত্রণের অনুভূতি দেয়।
- প্রত্যাশা তত্ত্ব (Expectation Theory) অনুসারে, মানুষ তাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পটভূমির ভিত্তিতে অবচেতন ভাবে যা প্রত্যাশা করে, মৃত্যুর কাছাকাছি অভিজ্ঞতার সময় সে তাই অনুভব করে।মনের গভীরে সঞ্চিত বিশ্বাস ও চিত্রাবলিই সেই অভিজ্ঞতার রূপ কেমন হবে, তা নির্ধারণ করতে পারে। এর ফলে, মানুষ নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার সময়ে প্রায়ই এমন প্রতীক, চরিত্র বা স্থান দেখে যা তাদের ব্যক্তিগত বা সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে। উদাহরন স্বরূপ, মৃত্যুর কাছাকাছি অবস্থায় একজন খ্রিস্টান যিশুকে দেখতে পারেন, আবার একজন হিন্দু যম দেবতাকে দেখতে পারেন।
- কিছু ওষুধ, বিশেষ করে কেটামিনের মতো অ্যানাস্থেটিক বা চেতনানাশক, এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে যা নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়। এর মধ্যে শরীরের বাইরে থাকার অনুভূতি এবং উজ্জ্বল আলো দেখার মতো অভিজ্ঞতা উল্লেখ করার মতো। এই পদার্থগুলো মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্য পাল্টে দেয়, যা মানুষের ধারণা, সময়বোধ ও আত্মসচেতনতার ওপর প্রভাব ফেলে। যার ফলে, ব্যবহারকারীরা প্রায়ই এমন অভিজ্ঞতার কথা জানান যা মৃত্যুর কাছাকাছি অবস্থার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিলে যায়।
- এটি ইঙ্গিত করে যে নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা চরম মানসিক চাপ বা আঘাতের মুহূর্তে রাসায়নিকভাবে উদ্দীপ্ত হতে পারে। এমন অবস্থায় মস্তিষ্ক কিছু নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসরণ করে, যা নির্দিষ্ট ওষুধের প্রভাবের অনুকরণ করতে পারে। এই ধরনের রাসায়নিক প্রতিক্রিয়াই মৃত্যুর কাছাকাছি অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পর্কিত তীব্র অনুভূতি এবং জীবন্ত দৃশ্যের সৃষ্টি করতে পারে।
- কিছু গবেষক প্রস্তাব করেন যে নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার একটি অভিযোজনমূলক মূল্য (Adaptive Value) থাকতে পারে। অর্থাৎ, মৃত্যুর মুহূর্তে এটি মানুষকে সান্ত্বনা দেয় অথবা মানুষের মনে এটি বেঁচে থাকার ইচ্ছা জাগিয়ে টিকে থাকার প্রেরণা সৃষ্টি করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা জীবনের জন্য হুমকি বয়ে আনে এমন পরিস্থিতিতে ভয় ও আতঙ্ক কমিয়ে একটি বিবর্তনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে। শান্তি বা আশার অনুভূতি প্রদান করার মাধ্যমে নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা শরীর ও মনকে চরম মানসিক চাপ সহ্য করতে সাহায্য করতে পারে এবং রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বাড়াতে পারে।
নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা নিয়ে চলমান বিতর্ক
নিকট-মৃত্যুর অভিজ্ঞতার পেছনের রহস্য উদঘাটনের জন্য এই পর্যন্ত যেসব ব্যাখ্যা
হাজির করা হয়েছে তা নিয়ে বিজ্ঞানী, দার্শনিক এবং আধ্যাত্মিক চিন্তাবিদদের মধ্যে
চরম পর্যায়ের বিতর্ক রয়ে গেছে। কেউ কেউ এটিকে পরকালের এক ঝলক বা আত্মার
অমরত্বের প্রমাণ হিসেবে দেখে থাকেন। আবার অন্যরা এটিকে জটিল স্নায়ুবিজ্ঞানের
প্রতিক্রিয়া বা মস্তিষ্কের হ্যালুসিনেশন (বিভ্রম) হিসেবে বিবেচনা
করেন। এই চলমান বিতর্ক জীবন, মৃত্যু এবং চেতনা (Consciousness) সম্পর্কে
আমাদের বোঝাপড়াকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে চলেছে।
আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার সমর্থকরা যুক্তি দেন যে নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে
যে মানব চেতনা শরীরের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং এর বাইরেও তার অস্তিত্ব আছে। তাঁরা
বিশ্বাস করেন যে এই অভিজ্ঞতাগুলো শারীরিক জগতের সীমা ছাড়িয়ে আত্মার নতুন কোন
জগতে প্রবেশ করার ইঙ্গিত বহন করে। তাঁদের মতে, নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা কোনো
বিভ্রম (Hallucination) নয়, বরং এটি ব্যাক্তির সাথে একটি প্রকৃত আধ্যাত্মিক
জগতের সংযোগের অভিজ্ঞতা।
এই সমর্থকরা প্রায়ই এমন ঘটনার উল্লেখ করেন, যেখানে মানুষ অচেতন অবস্থায় থাকার
পরেও তার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনার সঠিক বর্ণনা দিতে পেরেছে। ভুক্তভোগী
ব্যাক্তির তার হাসপাতালের বেডের আশেপাশে চিকিৎসা সরঞ্জাম দেখা, তাকে দেখতে আসা
আত্মীয় স্বজন এবং পরিবারের লোকজনের কথোপকথন শোনা, বা নিজের শরীরের উপরে ভেসে
থাকার অভিজ্ঞতার মতো ঘটনাগুলোকে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন
করেন। তাঁদের মতে, এমন অভিজ্ঞতা সাধারণ ইন্দ্রিয়ের সীমার বাইরে কোনো এক
উপলব্ধির অস্তিত্বকে নির্দেশ করে।
তবে সংশয়বাদীরা এই ঘটনার সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন। তাঁরা মনে করেন, অচেতন
অবস্থায় ভুক্তভোগীদের দেওয়া এসব সঠিক বর্ণনা আসলে কাকতালীয় অনুমান, খণ্ডিত
স্মৃতি (Fragmented Memory), বা আংশিক ইন্দ্রিয়-বোধের (Partial Sensory
Perception) ফল হতে পারে। তাঁদের মতে, অসাধারণ দাবির জন্য অসাধারণ প্রমাণ
প্রয়োজন, এবং এখন পর্যন্ত কোনো তথ্যই মস্তিষ্কের বাইরে চেতনার অস্তিত্ব
নিশ্চিত করেনি।
শেষ পর্যন্ত, এই বিতর্ক মানব অস্তিত্বের প্রকৃতি নিয়ে আমাদের সামনে কিছু গভীর
প্রশ্ন তুলে ধরে। উদাহরন হিসেবে বলা যায় যে, চেতনা কি কেবলই দেহের স্নায়ুগুলোর
ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সমষ্টিগত রূপ, নাকি এটি দেহের শারীরিক সীমা
অতিক্রম করে যায়? নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার রহস্য এভাবে বিজ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা এবং
পরকালের অস্তিস্ব খোঁজার মধ্যে এক নিরন্তর সেতুবন্ধন তৈরি করে চলেছে।
নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার মনস্তাত্ত্বিক এবং আধ্যাত্বিক প্রভাব
নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা যে কারনেই ঘটুক না কেন, ব্যাক্তির উপরে এর রুপান্তরমূলক
প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। এই পরিবর্তনগুলো ইঙ্গিত করে যে নিকট-মৃত্যু
অভিজ্ঞতা, তা পরজীবনের বাস্তব ঝলকই হোক বা কেবল মানসিক ঘটনাই হোক, গভীর
চিকিৎসাগত ও অস্তিত্ত্বমূলক (Existential) তাৎপর্য বহন করে। মৃত্যুর মুখ থেকে
ফিরে আসা ব্যক্তিরা প্রায়ই জীবন পরিবর্তনকারী অভিজ্ঞতার কথা জানান। এগুলো
হলোঃ
মৃত্যুর ভয় কমে যাওয়াঃ নিকট-মৃত্যুর অভিজ্ঞতা লাভ করা অধিকাংশ ব্যাক্তিই মৃত্যুকে আর ভয়ের
কিছু নয়, বরং এক শান্তিপূর্ণ রূপান্তর হিসেবে দেখতে শুরু করেন। তাঁরা প্রায়শই
মৃত্যুকে সমাপ্তি হিসেবে না দেখে, এটিকে অস্তিত্বের আরেকটি রূপে অব্যাহত যাত্রা
হিসেবে বর্ণনা করেন। এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তাঁদের মধ্যে মৃত্যুর অনিবার্যতার
প্রতি প্রশান্তি ও গ্রহণযোগ্যতার অনুভূতি নিয়ে আসে।
জীবনের প্রতি গভীর মূল্যায়নঃ অনেকেই এই অভিজ্ঞতার পর কৃতজ্ঞতা, উদ্দেশ্য (Purpose) এবং সহমর্মিতার এক
গভীর অনুভূতি অর্জন করেন। তাঁদের কাছে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাগুলো আরও অর্থবহ হয়ে
ওঠে, আর ছোট ছোট সৌন্দর্যের মুহূর্তগুলো আনন্দের উৎসে পরিণত হয়। এই নতুন
দৃষ্টিভঙ্গি তাঁদেরকে আরও পূর্ণতা ও আন্তরিকতার সাথে জীবনযাপন করতে অনুপ্রাণিত
করে।
মূল্যবোধের পরিবর্তনঃ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা লাভ করার পরে ব্যাক্তির মনে
বস্তুগত অর্জনের গুরুত্ব প্রায়শই কমে যায়। এর পরিবর্তে তাদের কাছে
আধ্যাত্মিকতা, ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং অন্যের উপকার করার প্রবণতা বেশি প্রাধান্য
পায়। অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা জীবনে সত্যিকারভাবে কোন বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ, তা
নতুনভাবে মূল্যায়ন করেন। এর ফলে তাঁরা সম্পদ বা মর্যাদার চেয়ে ভালোবাসা, দয়া
ও আত্মিক বিকাশকে অগ্রাধিকার দিতে শেখেন।
বর্ধিত মানসিক বা অন্তর্দৃষ্টিগত ক্ষমতাঃ কিছু ব্যক্তি নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার পর অধিক সংবেদনশীলতা,
ভবিষ্যদ্বাণীমূলক ধারণা বা চিকিৎসাশক্তির দাবি করেন। তাঁরা প্রায়শই নিজেদের
অন্তর্দৃষ্টি আরও শক্তিশালী এবং অন্যান্য মানুষ ও পৃথিবীর সঙ্গে গভীর সংযোগ
অনুভব করেন। এসব অভিজ্ঞতা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হোক বা না হোক, তা তাঁদের
বাস্তবতার ধারণায় এক গভীর প্রভাব ফেলে।
নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা নিয়ে গবেষনা করার সীমাবদ্ধতা
নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা নিয়ে গবেষকদের ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও, এটি নিয়ে গবেষনার
কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই সীমাবদ্ধতাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে,
নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা মানুষের মন সম্পর্কে মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি দিলেও, এটি
মৃত্যুর পরের জীবনের অস্তিত্ব প্রমাণ বা অস্বীকার, কোনোটিই নিশ্চিতভাবে করতে
পারে না। এরকম কিছু সীমাবদ্ধতা হলোঃ
নিরপেক্ষতার অভাবঃ নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা হলো একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, যাকে কোনো
নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নিরপেক্ষভাবে মাপা বা পুনরায় উৎপাদন করা যায় না। প্রতিটি
অভিজ্ঞতাই অনন্য এবং তা ব্যক্তির বিশ্বাস, আবেগ ও প্রত্যাশার দ্বারা প্রভাবিত
হয়ে থাকে। ফলে গবেষকদের জন্য এই অভিজ্ঞতাগুলোকে বৈজ্ঞানিকভাবে যাচাই বা একে
অপরের সাথে তুলনা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
স্মৃতিবিকৃতিঃ আঘাত পাওয়া অবস্থায় মানুষের মস্তিস্ক তার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর
তথ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারে না, যা নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার বর্ণনার
নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি করে। মানসিক চাপ, অক্সিজেনের অভাব এবং ওষুধের
প্রভাব এগুলো সবই অনুভূতি এবং স্মৃতি গঠনের প্রক্রিয়াকে পরিবর্তন করে দিতে
পারে। এর ফলে স্মৃতিতে বাস্তব অনুভূতির সঙ্গে কল্পিত বা পুনর্গঠিত বিবরণ মিশে
যেতে পারে।
সাংস্কৃতিক পক্ষপাতঃ নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা নিয়ে বেশিরভাগ গবেষণাই পশ্চিমা সংস্কৃতির ওপর
নির্ভর করে করা হয়েছে, যা এর সংস্কৃতিগত বৈশিষ্ট্যগুলোকে অতিরঞ্জিতভাবে
সাধারণীকরণের (overgeneralization) ঝুঁকি তৈরি করে। আসলে ভিন্ন ভিন্ন সমাজের
মানুষ নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতাকে নিজেদের আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে
ব্যাখ্যা করে থাকেন। এটি আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট
NDE-এর অভিজ্ঞতা ও তার ব্যাখ্যাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
প্রকাশনার পক্ষপাতঃ নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা নিয়ে নাটকীয় অভিজ্ঞতাগুলো সাধারণ বা বিরোধী ঘটনার
(অর্থাৎ নেতিবাচক বা কম আকর্ষণীয়) তুলনায় বেশি প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা
থাকে। গবেষক ও গণমাধ্যম প্রায়ই এমন সেনসেশনাল বা আকর্ষণীয় ঘটনাগুলোকে গুরুত্ব
দেয় যা জনসাধারণের আগ্রহ জাগায়। এর ফলস্বরূপ, নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা (NDE)
সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়া কতিপয় অসাধারণ উদাহরণের দিকে ঝুঁকে পড়ে, যা
নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার পুরো পরিসরকে প্রতিফলিত করে না।
নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা নিয়ে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
স্নায়ুবিজ্ঞান ও পুনরুজ্জীবন চিকিৎসায় (Resuscitation Medicine) অগ্রগতি
নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা নিয়ে গবেষণার নতুন সুযোগ তৈরি করছে। আধুনিক প্রযুক্তির
সাহায্যে বিজ্ঞানীরা রোগীদের হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং তা পুনরায় চালু
হওয়ার সময়ে রোগীদের মস্তিস্ককে বিশদভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হচ্ছেন, যা আগে
কল্পনাও করা যেত না। এসব উদ্ভাবন মস্তিষ্ক যখন ক্লিনিক্যাল মৃত্যুর কাছাকাছি বা
তার পরবর্তী অবস্থায় থাকে, তখন চেতনা (consciousness) কীভাবে আচরণ করে, তা
বোঝার নতুন পথ উন্মোচন করছে।
হৃদযন্ত্র বন্ধ থাকার সময় উন্নত পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তি একদিন হয়তো আমাদেরকে
স্পষ্ট করে বলে দিতে পারবে যে, মস্তিষ্কের কার্যকলাপের বাইরেও চেতনা অব্যাহত
থাকে কি না। গবেষকেরা আজকাল এমন সরঞ্জাম তৈরি করছেন যা মস্তিস্কের সূক্ষ্ম
বৈদ্যুতিক বা রাসায়নিক সংকেত শনাক্ত করতে পারে, যা মৃত্যুর পরেও সচেতনতার
ইঙ্গিত দিতে পারে। এ ধরনের গবেষণা জীবন, মৃত্যু এবং মানব উপলব্ধির সীমা
সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে।
বৃহৎ পরিসরে আন্তঃসাংস্কৃতিক গবেষণাও নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার সার্বজনীন এবং
সংস্কৃতিনির্ভর বৈশিষ্ট্যগুলোর গভীরতর বোঝাপড়া গড়ে তুলতে পারে। বিভিন্ন ধর্ম,
সমাজ ও বিশ্বাসব্যবস্থার অভিজ্ঞতাগুলো তুলনা করে গবেষকেরা জৈবিক উপাদান এবং
সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেন। অর্থাৎ, এই রকমের
ব্যাপক গবেষনা নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার কোন দিকগুলো মানুষের মস্তিস্কের ক্রিয়া
প্রতিক্রিয়ার ফল আর কোনগুলো মানুষের সম্মিলিত বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি তা বের করে
আনতে পারবে বলে আশা করা যায়।
আন্তঃবিষয়ক সংলাপ, অর্থাৎ স্নায়ুবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, ধর্মতাত্ত্বিক ও
দার্শনিকদের মধ্যে আলোচনা, নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা দ্বারা উত্থাপিত গভীর
প্রশ্নগুলোর অনুসন্ধানে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রতিটি ক্ষেত্রই
চেতনা ও অস্তিত্বের রহস্য সম্পর্কে আমাদেরকে একটি অনন্য দৃষ্টিকোণ প্রদান করে।
উদাহরন স্বরূপ, স্নায়ুবিজ্ঞানীরা নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতার জৈবিক কারণ খোঁজেন,
মনোবিজ্ঞানীরা ব্যাক্তি ও সমাজের উপরে এর মানসিক প্রভাব বিশ্লেষণ করেন,
ধর্মতাত্ত্বিকেরা এর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বিচার করেন, এবং দার্শনিকেরা একে
উদাহরন হিসেবে ব্যবহার করে অস্তিত্বের প্রকৃতি নিয়ে প্রশ্ন করে থাকেন।
এই সহযোগিতার মাধ্যমেই মানবজাতি ধীরে ধীরে এই মৌলিক প্রশ্নের কাছাকাছি
পৌঁছাচ্ছে: নিকট-মৃত্যু অভিজ্ঞতা কি শুধুই একটি মস্তিষ্কনির্ভর ঘটনা, নাকি এটি
আমাদেরকে বাস্তবতার এক গভীরতর স্তরের আভাস দেয়।
শেষ কথা
মৃত্যুর কাছাকাছি অভিজ্ঞতাগুলো বিজ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা এবং দর্শনের সংযোগস্থলে
এক অনন্য অবস্থান দখল করে আছে। এগুলো জীবন ও মৃত্যুকে নিয়ে আমাদের চিরাচরিত
ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে মানব চেতনার অসাধারণ মাত্রাকে প্রকাশ করে।
স্নাযুবিজ্ঞান (Neuroscience) , মনোবিজ্ঞান, বা পরজগতের ঝলক যেভাবেই এগুলোকে
ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, মৃত্যুর কাছাকাছি অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয়
স্তরেই গভীর প্রভাব ফেলে। এগুলো বস্তুবাদী ব্যাখ্যার সীমা অতিক্রম করে
সম্ভাবনার এক জানালা খুলে দেয় এবং অস্তিত্বের রহস্য ও অর্থ সম্পর্কে আমাদের
মনে গভীরতর উপলব্ধি জাগিয়ে তোলে।
অতিপ্রাকৃতিক ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url