স্লিপ প্যারালাইসিস (বোবায় ধরা)
ঘুম হলো শারীরিক ও মানসিক বিশ্রামের একটি মৌলিক প্রক্রিয়া, যা শরীর ও মনের পুনরুদ্ধার বা বিশ্রামের জন্য তথা জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য। তবে, এই প্রশান্তির সময়েও কিছু অদ্ভুত এবং ভীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। এর মধ্যে স্লিপ প্যারালাইসিস (Sleep Paralysis) একটি বিশেষভাবে ভয়াবহ অবস্থা। এই পরিস্থিতিতে, মানুষ ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগে বা ঘুম ভাঙার ঠিক মুহূর্তে সম্পূর্ণ সজাগ থাকা সত্ত্বেও কথা বলতে বা শরীর নাড়াতে সম্পূর্ণ অক্ষম হয়ে পড়ে।এই সময় প্রায়শই ভয়াবহ বিভ্রম (Hallucinations) ঘটে, যেমন ঘুমন্ত ব্যক্তিরা তাদের ঘরে জীবন্ত কোনো কিছুর উপস্থিতি বা অদৃশ্য সত্তার অনুভূতি পেয়ে থাকেন, যা অভিজ্ঞতাটিকে আরও ভয়ঙ্কর করে তোলে।
স্নায়ুবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং লোকবিশ্বাসের এক সীমান্তরেখায় অবস্থান করে এই বিশেষ ঘটনাটি চিকিৎসক, দার্শনিক এবং সাধারন মানুষদের যুগ যুগ ধরে মুগ্ধ করে রেখেছে। আধুনিক বিজ্ঞান এটিকে ঘুমের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার ত্রুটি হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও, এর তীব্র এবং ভীতিকর প্রকৃতির জন্য এটিকে আজও বিভিন্ন সংস্কৃতিতে দানব, আত্মা বা অতিপ্রাকৃত শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার মতো ব্যাখ্যাকে অনুপ্রাণিত করে আসছে।সূচিপত্রঃ স্লিপ প্যারালাইসিস (বোবায় ধরা)
- স্লিপ প্যারালাইসিস কি জিনিস?
- স্লিপ প্যারালাইসিস নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি
- স্লিপ প্যারালাইসিসের পেছনের নিউরোলজিক্যাল কারণগুলো
- স্লিপ প্যারালাইসিসের মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো
- স্লিপ প্যারালাইসিসের নৃতাত্ত্বিক বয়ান
- স্লিপ প্যারালাইসিসের চিকিৎসা এবং একে প্রতিরোধ করার উপায়
- স্লিপ প্যারালাইসিস নিয়ে চলমান বৈজ্ঞানিক গবেষনা ও বিতর্ক
- বিভিন্ন শিল্পকর্ম এবং গনমাধ্যমে স্লিপ প্যারালাইসিসের বর্ননা
- শেষ কথা
স্লিপ প্যারালাইসিস কি জিনিস?
স্লিপ প্যারালাইসিসকে প্যারাসমনিয়া (Parasomnia) নামক ঘুমজনিত ব্যাধির একটি
উপশ্রেণি হিসেবে ধরা হয়। এই ব্যাধিটিকে ঘুমের সময় অস্বাভাবিক আচরণ বা অভিজ্ঞতা
দ্বারা চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এটি মূলত যখন আমাদের জেগে থাকা অবস্থা এবং ঘুমের
র্যাপিড আই মুভমেন্ট (REM,
ঘুমের একটি পর্যায় যার বৈশিষ্ট্য হল দ্রুত চোখের নড়াচড়া, মস্তিষ্কের
কার্যকলাপ বৃদ্ধি এবং প্রাণবন্ত স্বপ্ন দেখা) অংশের স্বাভাবিক স্থানান্তর প্রক্রিয়াটি কোনো কারণে ব্যাহত হয় তখন ঘটে
থাকে।
স্বাভাবিক REM ঘুমের সময়, আমাদের মস্তিষ্ক "REM অ্যাটোনিয়া" নামে একটি পদ্ধতির
মাধ্যমে শরীরের অধিকাংশ পেশির কার্যকলাপকে দমন করে রাখে। এর উদ্দেশ্য হলো, আমরা
যেন স্বপ্ন দেখার সময় সে অনুযায়ী শারীরিকভাবে নড়াচড়া না করি। স্লিপ
প্যারালাইসিস ঠিক তখনই হয়, যখন ব্যক্তি সচেতন হয়ে উঠলেও শরীরের পেশিগুলির উপর
নিয়ন্ত্রণ তখনও ফিরে আসে না। ব্যাক্তির মন জেগে ওঠে কিন্তু শরীর তখনও গভীর ঘুমে
পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় থাকে। অন্যভাবে বলা যায়, ব্যক্তি জেগে থেকেও নড়াচড়া
করতে পারে না।
স্লিপ প্যারালাইসিসের দুটি প্রধান ধরন রয়েছে। এগুলো হলোঃ
হিপনাগগিক স্লিপ প্যারালাইসিস (Hypnagogic Sleep Paralysis), যা ঘুমিয়ে
পড়ার সময় ঘটে।
হিপনোপম্পিক স্লিপ প্যারালাইসিস (Hypnopompic Sleep Paralysis), যা ঘুম
থেকে জেগে ওঠার সময় ঘটে।
একটি স্লিপ প্যারালাইসিসের পর্ব চলাকালীন সময়ে ব্যক্তি তার চারপাশে ঘটে যাওয়া
ঘটনাগুলো সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ থাকেন, কিন্তু সে একেবারেই নড়াচড়া বা কথা বলতে
পারে না। এই সময় অনেকেই শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ার এবং বুকে তীব্র চাপের অনুভূতি
জানান। সাধারণত, এই অবস্থাটি কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী
হয়, তবে এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কারণে সময়টি আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে অনেক দীর্ঘ
বলে মনে হতে পারে।
চিকিৎসাগতভাবে এটি শরীরের কোন ক্ষতি করেনা, কিন্তু এর ভীতিকর এবং তীব্র অভিজ্ঞতার
জন্য এটি আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে গভীর মানসিক কষ্টের সৃষ্টি করতে পারে।
স্লিপ প্যারালাইসিস নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি
স্লিপ প্যারালাইসিস নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষনা শুরু হবার আগে, স্লিপ প্যারালাইসিসের
অভিজ্ঞতাকে প্রায়শই অতিপ্রাকৃতিক বিশ্বাস দিয়ে ব্যাখ্যা করা হতো। মধ্যযুগীয়
ইউরোপে এই অবস্থার শিকার হওয়া মানুষরা বিশ্বাস করতেন যে রাতের বেলায় ঘুমের সময় এক
নাইট হ্যাগ বা রাত্রির ডাইনি/দানব তাদের বুকের উপর বসে থাকত। এটি এক
ধরনের অশুভ আত্মার মত ছিল যা ঘুমন্ত মানুষের বুকের ওপর চেপে বসে শ্বাসরোধ করে
তাদের যন্ত্রণা দিত।
অষ্টাদশ শতকের বিখ্যাত শিল্পী হেনরি ফুসেলি (Henry Fuseli) তাঁর কালজয়ী চিত্রকর্ম
দ্য নাইটমেয়ার (The Nightmare)-এ এই ভয়ংকর লোকবিশ্বাসকে জীবন্ত করে
তুলেছেন। এই চিত্রে একজন অসহায় ঘুমন্ত ব্যক্তিকে এক বিকট ইনকিউবাসের (পুরুষ
শয়তানের একটি রূপ) নিচে দেখানো হয়েছে, যা স্লিপ প্যারালাইসিসের তীব্র ভীতিকর
অনুভূতিকে আমাদের কাছে তুলে ধরে।
জাপানিজ সংস্কৃতিতে এই অবস্থাকে কানাশিবারি (Kanashibari) বা
লোহা দিয়ে বাঁধা বলা হয়ে থাকে। সেখানে ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বাস করা হয় যে
ব্যাক্তির উপরে প্রতিহিংসাপরায়ণ আত্মাদের কার্যকলাপের ফলে স্লিপ প্যারালাইসিস
ঘটে থাকে। অপরদিকে নাইজেরিয়ার কিছু অঞ্চলে, এটিকে ডাইনিবিদ্যা বা শয়তানি
আক্রমণের ফল বলে মনে করা হয়। আবার কিছু মুসলিম সংস্কৃতিতে, এই অভিজ্ঞতাকে কখনও
কখনও ঘুমের মধ্যে ব্যাক্তির সাথে জিনের সাক্ষাতের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করা
হয়ে থাকে।
এই ধরনের সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যাগুলো প্রমাণ করে যে স্লিপ প্যারালাইসিস একটি
আন্তঃসাংস্কৃতিক (Cross-Cultural) ঘটনা, যা বিশ্বের প্রায় সব সমাজেই বিদ্যমান
রয়েছে। তবে, এটি প্রতিটি সমাজে নিজস্ব অর্থ ও রূপ ধারণ করে।
আধুনিক সময়ে এসে, স্লিপ প্যারালাইসিসের চিত্রকল্প পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে জনপ্রিয়
ইউএফও অপহরণের গল্পেও প্রবেশ করেছে। অনেক ভিনগ্রহবাসীর দ্বারা অপহরণ-এর
বিবরণ স্লিপ প্যারালাইসিসের সাধারণ লক্ষণের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়, যেমনঃ অচল ও
পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় জেগে ওঠা, মানবসদৃশ অবয়ব দেখা, অদৃশ্য উপস্থিতির
অনুভূতি, এবং ভেসে থাকার বা বুকে চাপের সংবেদন অনুভব করা।
পণ্ডিতদের মতে, যদিও সাংস্কৃতিক প্রতীক বা মোটিফ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রূপ
পরিবর্তিত করে (যেমন 'নাইট হ্যাগ' থেকে 'ভিনগ্রহবাসী'), তবুও এর অন্তর্নিহিত
স্নায়ুবিষয়ক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াটি (REM অ্যাটোনিয়া) একই রকম থাকে।
স্লিপ প্যারালাইসিসের পেছনের নিউরোলজিক্যাল কারণগুলো
জৈবিকভাবে বলতে গেলে, স্লিপ প্যারালাইসিস হলো র্যাপিড আই মুভমেন্ট (REM) ঘুমের
একটি বিচ্ছিন্নতাজনিত ঘটনা। REM ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্ক সর্বোচ্চ সক্রিয়
থাকে এবং তখনই সবচেয়ে স্পষ্ট ও জীবন্ত স্বপ্ন দেখা যায়। এই সময়ে মস্তিষ্কের
ব্রেইনস্টেমে অবস্থিত পন্টাইন রেটিকুলার ফরমেশন (Pontine Reticular Formation)
নামক অংশটি মেরুদণ্ডের মোটর নিউরনে (Spinal Motor Neurons) এক ধরনের প্রতিবন্ধক
সংকেত পাঠায়। এই সংকেতের কারণেই ঘুমের সময়ে আমাদের শরীরের পেশিগুলোতে শিথিলতা বা
অ্যাটোনিয়া তৈরি হয়। এই পক্ষাঘাতজনিত অবস্থা মূলত আমাদের স্বপ্ন দেখার সময়
শরীরকে বাস্তবে অবাঞ্ছিত নড়াচড়া করা এবং উল্টাপাল্টা আচরন করা থেকে বিরত রাখে।
তবে, যখন REM ঘুম এবং জাগ্রত অবস্থার মধ্যেকার স্বাভাবিক সীমা বিঘ্নিত হয়, তখন
অনেকেই REM অ্যাটোনিয়ার (পেশি পক্ষাঘাত) প্রভাবে থাকা অবস্থাতেই সচেতনতা ফিরে
পান। এই সময়ে, মস্তিষ্কের অনুভূতিজনিত এবং আবেগ-নিয়ন্ত্রণকারী কেন্দ্রগুলো
(বিশেষ করে অ্যামিগডালা এবং লিম্বিক সিস্টেম) অতিসক্রিয় অবস্থায় থাকে। এর ফলে,
শরীর স্থির বা অচল থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তির মধ্যে তীব্র ভয় এবং অতিমাত্রার
সচেতনতার অনুভূতি সৃষ্টি হয়।
স্লিপ প্যারালাইসিসের সময় যে বিভ্রমগুলো (Hallucinations) দেখা যায়, সেগুলো
প্রধানত স্বপ্নের চিত্র এবং ব্যাক্তির জেগে থাকা সময়ের উপলব্ধির একধরনের মিশ্রণ
বা ওভারল্যাপের ফল। এই অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তি স্বপ্নের উপাদানগুলোকে তাদের
বাস্তব পরিবেশের ওপর আরোপ করেন। এর ফলে তারা ঘরের মধ্যে ছায়ামূর্তির উপস্থিতি বা
অনুপ্রবেশকারী দেখতে পান। এই ধরনের অনুপ্রবেশকারী বা
ইনকিউবাস এর বিভ্রমগুলো বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে আশ্চর্যজনকভাবে
একই রকম দেখতে পাওয়া যায়। এই মিল থেকে ধারণা করা হয় যে, কিছু নির্দিষ্ট
স্নায়বিক অবস্থায় আমাদের মস্তিষ্ক আদিরূপী (archetypal) এবং সার্বজনীন কিছু
চিত্র বা প্রতীক তৈরি করে থাকে।
বিভিন্ন কারনে একজন ব্যাক্তির স্লিপ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত্র হবার ঝুঁকি বেড়ে
যায়। এগুলো হচ্ছেঃ
- ঘুমের অভাব বা অনিয়মিত ঘুমের সময়সূচি
- জেট ল্যাগ (দীর্ঘ সময় ধরে বিমান ভ্রমণের পর ক্লান্তি, ঘুম ও হজমের সমস্যা হওয়া) এবং সার্কাডিয়ান রিদমের (প্রায় ২৪ ঘণ্টার একটি প্রাকৃতিক জৈবিক চক্র, যা শরীরের ঘুম-জেগে উঠা সহ বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে ) ব্যাঘাত ঘটা
- মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা ট্রমা
- নারকোলেপসি (দিনের বেলায় অতিরিক্ত ঘুম আসার প্রবনতা) ও সংশ্লিষ্ট REM ঘুমজনিত ব্যাধি
- পিঠের উপর শোয়া অবস্থায় চিৎ হয়ে ঘুমিয়ে থাকার অভ্যাস
স্লিপ প্যারালাইসিসের মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো
নিউরোলজিক্যাল বা স্নায়ুবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা স্লিপ প্যারালাইসিসের প্রক্রিয়াগত
দিকটি আমাদের কাছে স্পষ্ট করে তুলে ধরলেও, এটি স্লিপ প্যারালাইসিসের সময়ে চলমান
অভিজ্ঞতার মনস্তাত্ত্বিক তীব্রতাকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারে না। এই অভিজ্ঞতা
চলাকালীন সময়ে অসহায়তার অনুভূতি এবং ঘরে অদৃশ্য কারও উপস্থিতির উপলব্ধি থেকেই
ভুক্তভোগীদের ভয় আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
মানুষের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করা মনোবৈজ্ঞানিকদের মতে, স্লিপ প্যারালাইসিস
চলাকালীন সময়ে মানব মস্তিষ্ক শারীরিকভাবে নড়াচড়া না করতে পারা এবং তীব্র ভয়
পাওয়ার একটি যৌক্তিক অর্থ খুজে বের করতে চেষ্টা করে। এই প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ,
মস্তিষ্ক একটি কৃত্রিম সত্তা বা Agent তৈরি করে, যাকে মস্তিষ্ক ঘটনাটির
মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে।
স্লিপ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত রোগীদের ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় তাদের ঘরে এক বা
একাধিক অদৃশ্য সত্তার উপস্থিতির অনুভূতি একটি সুপ্রমাণিত
মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা। এটি ঘটে যখন মস্তিষ্কের টেম্পোরো-প্যারিয়েটাল জংশন (TPJ),
যা আমাদের শরীরের সচেতনতার জন্য দায়ী, এবং আবেগ-প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রগুলোর
মধ্যেকার যোগাযোগ বিঘ্নিত হয়।মস্তিষ্ক যখন শরীরের অচলাবস্থা (পক্ষাঘাত) এবং
অতিরিক্ত মানসিক উত্তেজনা অনুভব করে, তখন সেই অনুভূতিটিকে বাহ্যিক আকার
দেয়। ফলে, ব্যক্তি মনে করেন যে ঘরে অন্য আরেকটি সত্তা উপস্থিত রয়েছে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে স্লিপ প্যারালাইসিসের সঙ্গে উদ্বেগজনিত ব্যাধি
(Anxiety Disorder), পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (PTSD) এবং বিষণ্নতার
(Depression) মতো মানসিক অসুস্থতার একটি যোগসূত্র রয়েছে। তবে, এক্ষেত্রে কারণ
এবং ফলের (Cause and Effect) মধ্যেকার সম্পর্কটি স্পষ্ট নয়। এমন হতে পারে যে
ব্যাক্তির জীবনের মানসিক অস্থিরতা REM ঘুমের স্থানান্তরকে ব্যাহত করে স্লিপ
প্যারালাইসিস ঘটাচ্ছে; অথবা উল্টোটাও হতে পারেঃ অর্থাৎ, ঘন ঘন স্লিপ
প্যারালাইসিসের অভিজ্ঞতা নিজেই ব্যক্তির মধ্যে উদ্বেগ ও মানসিক চাপ বাড়িয়ে
দিচ্ছে।
বহু ভুক্তভোগীর ক্ষেত্রে, এই অভিজ্ঞতা ঘুমের প্রতি আতঙ্ক সৃষ্টি করে, যার ফলে
দীর্ঘস্থায়ী অনিদ্রা দেখা দেয় এবং এটি একটি অবিরাম দুষ্টচক্র তৈরি করে।
অন্যদিকে, কিছু ব্যক্তি এই স্লিপ প্যারালাইসিসকে আধ্যাত্মিক বা রূপান্তরমূলক ঘটনা
হিসেবে গ্রহণ করেন। তাদের মতে, এটি চেতনার পরিবর্তিত অবস্থায় প্রবেশ করে
বাস্তবতাকে নতুন করে উপলব্ধি করার একটি পথ অথবা দেহের বাইরে অভিজ্ঞতা
(Out-of-Body Experience - OBE) অর্জনের একটি উপায় হিসেবে কাজ করে থাকে।
স্লিপ প্যারালাইসিসের নৃতাত্ত্বিক বয়ান
জীববিজ্ঞান এবং সংস্কৃতির মধ্যেকার সংযোগটি বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন আমরা
দেখি মানুষ স্লিপ প্যারালাইসিসকে কীভাবে ব্যাখ্যা করে এবং এর সঙ্গে কীভাবে
মোকাবিলা করে। নৃতত্ত্ববিদদের মতে, যেসব সমাজে এই অভিজ্ঞতার অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস
বা ব্যাখ্যা প্রচলিত রয়েছে, সেখানকার মানুষজন সাধারণত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বা
প্রার্থনার মাধ্যমে এর সঙ্গে লড়াই করে। অন্যদিকে, কিছু সমাজে এটিকে স্রেফ একটি
খারাপ স্বপ্ন হিসেবে গণ্য করে উপেক্ষা করা হয়।
আশ্চর্যজনকভাবে, গবেষণায় দেখা গেছে যে মানুষের বিশ্বাস স্লিপ প্যারালাইসিসের
তীব্রতাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। যেসব সংস্কৃতিতে এই ঘটনাকে বিপজ্জনক বা অশুভ
আত্মার আক্রমণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, সেসব স্থানের ভুক্তভোগীরা সাধারণত বেশি
ভয় এবং জটিল বিভ্রমের কথা জানান। এর বিপরীতে, যেসব ব্যক্তি একে একটি প্রাকৃতিক
ঘুমজনিত ব্যাধি কিংবা একটি আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা হিসেবে বোঝেন, তারা তুলনামূলকভাবে
কম মানসিক কষ্ট অনুভব করেন এবং অনেকে এই বিষয়টি নিয়ে কৌতূহলও প্রকাশ করেন।
আধুনিক কালে স্লিপ প্যারালাইসিস নিয়ে অনেক অনলাইন কমিউনিটি গড়ে উঠেছে যেখানে
ভুক্তভোগীরা তাদের অভিজ্ঞতাগুলো বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার মিশ্রণে ভাগ
করে নেন। মজার বিষয় হলো, কিছু মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে স্লিপ প্যারালাইসিস সৃষ্টি করার
চেষ্টা করেন। তারা এটিকে লুসিড ড্রিমিং (Lucid Dreaming) বা অ্যাস্ট্রাল প্রজেকশন
(Astral Projection) অর্জনের একটি উপায় হিসেবে দেখেন। এর মাধ্যমে তারা তাদের
তীব্র ভয়কে এক ধরনের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষমতায়নের অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত
করেন।
অর্থের এই ব্যাপক বৈচিত্র্য প্রমাণ করে যে, স্লিপ প্যারালাইসিস কেবল একটি
চিকিৎসাগত ব্যাধি নয়, এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনাও বটে। এই
অভিজ্ঞতা মানবমন এবং সমাজের সেই মৌলিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গঠিত হয়, যার
সাহায্যে তারা অজানাকে অর্থ ও ব্যাখ্যা প্রদান করে এবং একে নিজস্ব সাংস্কৃতিক
কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে।
স্লিপ প্যারালাইসিসের চিকিৎসা এবং একে প্রতিরোধ করার উপায়
চিকিৎসাগত দিক থেকে, স্লিপ প্যারালাইসিস বা নিদ্রা পক্ষাঘাতকে সাধারণত বিপজ্জনক
বলে মনে করা হয় না। তবে, ঘন ঘন এই ঘটনাগুলো ঘটলে তা ভুক্তভোগীদের জন্য
উল্লেখযোগ্য মানসিক চাপ ও অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে। সাধারণত, রোগের কারণ
নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকরা প্রথমে রোগীর ঘুমের ইতিহাস ভালোভাবে শোনেন। অনেক সময়
নারকোলেপসি বা অন্যান্য ঘুমজনিত রোগ নিশ্চিতভাবে বাদ দেওয়ার জন্য পলিসমনোগ্রাফি
(Polysomnography) নামক বিশেষ ঘুমের পরীক্ষা করানো হয়।
স্লিপ প্যারালাইসিসের চিকিৎসায় প্রধানত জীবনধারা এবং ঘুমের অভ্যাস (Sleep
Hygiene) উন্নত করার ওপর জোর দেওয়া হয়ে থাকে। এগুলো হলোঃ
- নিয়মিত ঘুমাতে যাওয়া ও ঘুম থেকে জেগে ওঠার সময় বজায় রাখা
- ঘুমের আগে ক্যাফেইনযুক্ত খাবার (যেমনঃ চা, কফি, চকোলেট, কোক, পেপসি) এবং ভারি খাবার এড়িয়ে চলা
- বিশ্রাম এবং ধ্যান বা মেডিটেশনের মতো কৌশলের মাধ্যমে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা
- পিঠের উপর ভর করে চিৎ হয়ে ঘুমানোর অভ্যাস ত্যাগ করা
গুরুতর অথবা ঘন ঘন স্লিপ প্যারালাইসিসের ক্ষেত্রে, চিকিৎসকরা কখনও কখনও
রোগিদেরকে অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট ওষুধ, যেমন সিলেকটিভ সেরোটোনিন রিইনটেক
ইনহিবিটরস (SSRI), সেবনের পরামর্শ দেন। এই ধরনের ওষুধ REM ঘুমকে দমন করে এবং
ফলস্বরূপ পর্বের সংখ্যা কমাতে সাহায্য করে।
এর পাশাপাশি, স্লিপ প্যারালাইসিসের চিকিৎসায় কগনিটিভ-বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT)
অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। এই থেরাপি রোগীদের তাদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাকে
নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে এবং সেই সংক্রান্ত মানসিক উদ্বেগ বা ভয় কমাতে সাহায্য
করে।
গুরুত্বপূর্ণভাবে, এই অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে সচেতনতা একটি প্রধান ভূমিকা পালন করে।
স্লিপ প্যারালাইসিস যে ক্ষতিকর নয় এবং সাময়িক, এই বিষয়টি জানা থাকলে তা নিয়ে
ভয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে পারে। মানুষ যখন এর পেছনের বৈজ্ঞানিক কারণগুলি
বুঝতে, তখন রাতে ঘুমানো নিয়ে তাদের আতঙ্ক প্রায়ই দূর হয়ে যায়, যদিও
পক্ষাঘাতের অভিজ্ঞতা নিজে থেকেই চলতে থাকে।
স্লিপ প্যারালাইসিস নিয়ে চলমান বৈজ্ঞানিক গবেষনা ও বিতর্ক
আধুনিক গবেষণা এখনও স্লিপ প্যারালাইসিস, স্বপ্ন এবং চেতনার মধ্যেকার অস্পষ্ট
সীমারেখা অনুসন্ধান করে চলেছে। নিউরোইমেজিং গবেষণাগুলো REM ঘুমের অনুপ্রবেশের
সঙ্গে যুক্ত নির্দিষ্ট মস্তিষ্কের সার্কিটগুলো শনাক্ত করার চেষ্টা করছে।
অন্যদিকে, মনোবিজ্ঞানীরা স্লিপ প্যারালাইসিস এবং লুসিড ড্রিমিং(এক ধরণের স্বপ্ন যেখানে একজন ব্যাক্তি স্বপ্ন দেখার সময় বুঝতে পারেন যে
তিনি স্বপ্ন দেখছেন)-এর মধ্যেকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও মিল বিশ্লেষণ করছেন।
কিছু গবেষকদের মতে, স্লিপ প্যারালাইসিস হলো চেতনার স্নায়ুবিজ্ঞান
(Neuroscience of Consciousness) বোঝার জন্য একটি অসাধারণ সুযোগ। তারা মনে করেন
যে স্লিপ প্যারালাইসিসকে এক ধরনের পরিক্ষা হিসেবে দেখা যেতে পারে যেখানে
মানুষের মন জেগে উঠলেও দেহ নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে। এই অবস্থাটি
মস্তিষ্কের অবস্থা এবং ব্যক্তিগত সচেতনতার মধ্যেকার সম্পর্ক সম্পর্কে গভীর ও
মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করে।
স্লিপ প্যারালাইসিসের আন্তঃসাংস্কৃতিক মহামারিবিদ্যা (Epidemiology,
বিশ্বজুড়ে এর প্রকোপ) নিয়ে মানুষের আগ্রহ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন
জরিপ থেকে জানা যায় যে, প্রায় ২০% থেকে ৫০% মানুষ তাদের জীবনে অন্তত একবার এই
অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন, যদিও এর প্রকৃত প্রকোপ অঞ্চলভেদে ভিন্ন হতে পারে।
বিশেষত শিক্ষার্থী, শিফট-ওয়ার্কার এবং দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপে থাকা
ব্যক্তিদের মধ্যে এর হার তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়।
তবুও, সকল বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির পরেও স্লিপ প্যারালাইসিস এখনও আংশিকভাবে রহস্যময়
রয়ে গেছে। এই রহস্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কিছু মৌলিক প্রশ্ন, যেমনঃ
- স্লিপ প্যারালাইসিস কেন বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং সমাজের মানুষদের মধ্যে এত মিল থাকা ভিজ্যুয়াল অভিজ্ঞতা (যেমন: অশুভ উপস্থিতি বা বুকের উপর চাপ) সৃষ্টি করে?
- কেন কেউ এই অভিজ্ঞতাকে তীব্র ভয়ের অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখে, আবার অন্যদের কাছে এটি পরমার্থিক বা উত্তরণমুখী (রূপান্তরমূলক) অনুভূতি হয়ে ওঠে?
বিভিন্ন শিল্পকর্ম এবং গনমাধ্যমে স্লিপ প্যারালাইসিসের বর্ননা
বিজ্ঞানকে ছাড়িয়ে গিয়ে স্লিপ প্যারালাইসিস শিল্প, সাহিত্য ও চলচ্চিত্রকে
গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। হেনরি ফুসেলির বিখ্যাত চিত্রকর্ম
দ্য নাইটমেয়ার থেকে শুরু করে Mara বা
The Haunting of Hill House এর মতো সমসাময়িক হরর চলচ্চিত্র পর্যন্ত, এক
অদৃশ্য শক্তির দ্বারা পীড়িত স্থবির ঘুমন্ত মানুষের চিত্রটি মানবজাতির
সার্বজনীন ভয়ের সঙ্গে গভীরভাবে অনুরণিত হয় এবং সাংস্কৃতিক উপাদানে জায়গা করে
নেয়।
এডগার অ্যালান পো এবং গি দ্য মোপাসাঁর মতো কিংবদন্তী সাহিত্যিকেরা তাঁদের
লেখায় মানব জীবনের ভঙ্গুর প্রকৃতি এবং মানব মনের তীব্র আতঙ্কের থিমগুলো তুলে
ধরার জন্য স্লিপ প্যারালাইসিসের চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন। এমনকি আধুনিক
মনোবিজ্ঞান-প্রভাবিত হরর চলচ্চিত্র, The Babadook ও এই ধারণাকেই
প্রতিফলিত করে। আর এই ধারনাটি হলোঃ প্রকৃত ভয় বাইরের কোনো দানব বা সত্তায় নেই,
বরং এটি মনেরই তৈরি করা অন্ধকার ছায়ায় লুকিয়ে থাকে।
এভাবে স্লিপ প্যারালাইসিস বিজ্ঞান ও মিথের মাঝামাঝি এক শক্তিশালী স্থানে
অবস্থান করে, যা প্রকাশ করে যে আত্ম-সত্তার সীমানা কতটা নাজুক, এবং মস্তিষ্ক কত
সহজেই এমন জগত সৃষ্টি করতে পারে যাকে বাস্তবতার চেয়েও বেশি বাস্তব মনে
হয়।
শেষ কথা
স্লিপ প্যারালাইসিস বা ঘুমের পক্ষাঘাত হলো ঘুম সংক্রান্ত একটি বিশেষ অবস্থা; যা
একইসাথে মস্তিষ্কের জটিল কার্যকলাপ, মনস্তত্ত্ব এবং সাংস্কৃতিক বিশ্বাসকে যুক্ত
করে। এটি স্বপ্ন দেখা এবং জেগে ওঠার মধ্যবর্তী সময়ে মস্তিষ্কের অত্যন্ত
সূক্ষ্ম প্রক্রিয়াগুলোকে আমাদের সামনে তুলে ধরে।
যদিও বর্তমান সময়ে বিজ্ঞান REM (Rapid Eye Movement) নিদ্রা এবং চেতনার
প্রক্রিয়া উন্মোচনে ক্রমাগত অগ্রসর হচ্ছে, তবুও আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই
সত্যটি মনে করিয়ে দেয় যে, কেবল মস্তিষ্ককে বোঝা এবং মানুষের মনকে
সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করা এক জিনিস নয়। এই অবস্থাটিকে রহস্যমুক্ত করতে হলে
আমাদের জৈবিক জ্ঞান (biological insight), সহানুভূতি (empathy) এবং সাংস্কৃতিক
বোঝাপড়ার সমন্বয় ঘটাতে হবে। এর ফলে স্লিপ প্যারালাইসিস ভয়ের উৎস হওয়ার
পরিবর্তে মানব চেতনার কার্যপ্রণালি দেখার জন্য এক মুগ্ধকর জানালায় রূপান্তরিত
হবে।




অতিপ্রাকৃতিক ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url