প্রজেক্ট এম কে আলট্রা - মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রন করার এক গোপন গবেষনা
প্রজেক্ট এমকে-আলট্রাকে (Project MK-ULTRA) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (CIA) দ্বারা পরিচালিত সবচেয়ে বিভীষিকাময় এবং গোপন কর্মসূচিগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলমান শীতল যুদ্ধের (12 March 1947 – 26 December 1991) শুরুর দিকে মানব চেতনাকে অধ্যয়ন এবং নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে এটি শুরু করা হয়েছিল। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা, বিভিন্ন রাসায়নিকের ব্যবহার এবং গোপন অভিযান চালানো হয়। যার ফলে, এই কর্মসূচি অমানবিক কষ্ট ও নৈতিক লঙ্ঘনের এক ভয়াবহ উত্তরাধিকার রেখে গেছে, যা আজও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করে আসছে।
১৯৭৩ সালে সিআইএ ইচ্ছাকৃতভাবে এমকে-আলট্রার অধিকাংশ নথি ধ্বংস করে ফেলে। তারপরেও
বেঁচে যাওয়া ডকুমেন্টস, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য এবং পরবর্তী তদন্তগুলো এটিকে
মানবাধিকারের এক বিশাল লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ করে।
এই প্রবন্ধে প্রজেক্ট এমকে-আলট্রার উৎপত্তি, কার্যপ্রণালি, অপব্যবহার, জনসমক্ষে
প্রকাশ এবং বিজ্ঞান, আইন ও জনবিশ্বাসের ওপর এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিশ্লেষণ করা
হবে।
সূচিপত্রঃ প্রজেক্ট এম কে আলট্রা - মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রন করার একটি গোপন গবেষনা
- প্রজেক্ট এমকে আলট্রার উৎপত্তির পেছনের কারণগুলো
- প্রজেক্ট এম কে আলট্রার কাঠামো
- মানুষের উপরে প্রায়োগিক গবেষনাঃ অনিচ্ছুক অংশগ্রহণকারী ও নৈতিক বিপর্যয়
- বৈজ্ঞানিক উচ্চাকাঙ্খা, প্যারানয়া এবং ছদ্মবিজ্ঞান
- এমকে আলট্রার রহস্য উন্মোচন এবং চার্চ কমিটির শুনানী
- এমকে আলট্রা প্রজেক্টের আইনগত এবং নৈতিক পরিনতি
- সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং একে নিয়ে তৈরি হওয়া ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
- সরকারি গোপনীয়তা এবং জনগনের বিশ্বাসের উপরে এমকে আলট্রার প্রভাব
- শেষ কথা
প্রজেক্ট এমকে আলট্রার উৎপত্তির পেছনের কারণগুলো
প্রজেক্ট এমকে-আলট্রা (MK-ULTRA)-কে সঠিকভাবে বুঝতে হলে এটিকে ঠান্ডা যুদ্ধকালীন
সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলমান ভূ-রাজনৈতিক
উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। সেই সময়ে বিশ্বের
প্রধান শক্তিগুলো (প্রধানত NATO এবং WARSAW PACT ভুক্ত দেশগুলো) সমগ্র
পৃথিবীর উপরে নিজেদের কৌশলগত আধিপত্য বজায় রাখা এবং বিস্তার করার জন্য
প্রতিযোগীতা করছিল; ফলে সেই সময়টি অবিশ্বাস, চরম গোপনীয়তা এবং একই সাথে দ্রুত
প্রযুক্তিগত উন্নতির এক যুগে পরিনত হয়েছিল। এই ধরনের পরিবেশে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ
(Psychological Warfare) পরিচালনার ক্ষমতা নিয়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর
দুশ্চিন্তা ক্রমশ বাড়তে থাকে।
১৯৪০-এর দশকের শেষভাগ এবং ১৯৫০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত
ইউনিয়নের মধ্যেকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা চরম আকার ধারণ করেছিল। এই প্রতিযোগিতা শুধু
দেশগুলোর নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা এবং মজুদ বাড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ
ছিল না; বরং বিশ্বব্যাপী গোয়েন্দা কার্যক্রম এবং মনস্তাত্ত্বিক
অপারেশন পরিচালনা করা, এবং আদর্শগত প্রভাব বিস্তার করা নিয়েও এই
প্রতিদ্বন্দ্বিতা চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। সেইসময়ে উভয় পক্ষই এই গভীর
আশঙ্কা করত যে, তাদের প্রতিপক্ষ হয়তো মানব আচরণ এবং চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণের
কোনো উন্নত পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেছে।
কোরিয়ান যুদ্ধের (25 June 1950 – 27 July 1953) সময় সোভিয়েত, চীনা এবং উত্তর কোরিয়ার
সেনাবাহিনী আমেরিকান যুদ্ধবন্দীদের ওপর উন্নত ব্রেইনওয়াশিং কৌশল প্রয়োগ
করছে; এই দাবি আমেরিকান গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মধ্যে মারাত্মক আতঙ্ক সৃষ্টি
করেছিল। বহু মার্কিন যুদ্ধবন্দী দেশে ফিরে এসে যখন কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রতি
সহমর্মিতা প্রকাশ করে বা তাদের দ্বারা সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের স্বীকারোক্তি দেয়,
তখন মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মধ্যে এই উদ্বেগ আরও জোরদার হয়।
ঠিক একই সময়ে, নতুন সাইকোট্রপিক পদার্থগুলোর আবিস্কার (বিশেষ করে এলএসডি (LSD), যা ১৯৪৩ সালে সুইস রসায়নবিদ আলবার্ট হফম্যান
আবিষ্কার করেছিলেন) বিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল জাগিয়ে তোলে। গবেষকরা দ্রুতই দেখতে পান যে
এই ধরনের পদার্থ মানুষের ধারণা ও চেতনাকে গভীরভাবে পরিবর্তন করতে সক্ষম। মানুষের
চেতনার উপরে তাদের তাদের অনিশ্চিত এবং শক্তিশালী মানসিক প্রভাব একই সঙ্গে
বিজ্ঞানী মহল এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, উভয়েরই বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
এলএসডি-কে এমন একটি পদার্থ হিসেবে বিবেচনা করা হতো যা স্মৃতি, ইন্দ্রিয়-অনুভূতি
এবং যুক্তিনির্ভর চিন্তাভাবনাকে সাময়িকভাবে নাটকীয়ভাবে বিকৃত করতে পারে। এর এই
অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যগুলো কিছু গবেষককে এই ধারণা দেয় যে, এটি মানব মনের গভীরতম
রহস্য উন্মোচনে সহায়ক হতে পারে। অন্যদিকে, অনেকে এই আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে এটি
সহজেই যেকোনো ব্যক্তির বাস্তবতার অনুভূতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ (CIA) বিশ্বাস করতে শুরু করে যে LSD এর মতো
রাসায়নিকগুলো জিজ্ঞাসাবাদ, গুপ্তচরবৃত্তি কিংবা মানসিক প্রভাব বিস্তারের অস্ত্র
হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এর ফলে সংস্থাটির নীতিনির্ধারকেরা মাদক দ্রব্য
ব্যবহার করে আগে থেকে টার্গেট করা ব্যাক্তিদের নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবিত করা যায়
এমন কৌশল নিতে উৎসাহ বোধ করে। শেষ পর্যন্ত, এসব প্রচেষ্টাগুলোই রাসায়নিক, জৈবিক
এবং মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার জন্য একটি গোপন বিভাগ প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তৈরি
করে।
১৯৫৩ সালে সিআইএ পরিচালক অ্যালেন ডালেস (Allen Dulles) রসায়নবিদ সিডনি গটলিয়েবের (Sidney Gottlieb) নেতৃত্বে এমকে-আলট্রা কর্মসূচিকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দেন। গটলিয়েব এবং
তাঁর দল প্রায় সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে এবং কার্যত কোনো রকম তদারকি ছাড়াই একটি
বিশাল মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার নেটওয়ার্ক পরিচালনা শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়,
কারাগার, হাসপাতাল, সেফ হাউস এবং এমনকি আন্তর্জাতিক স্থানেও এই পরীক্ষার
নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে ছিল। এসব পরীক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল কেবল মানব চেতনাকে বোঝাই নয়,
বরং এটি ভেঙে ফেলা, কর্তৃপক্ষের পছন্দমত পুনরায় গড়ে তোলা বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব
কি না, তা নিশ্চিত করা।
প্রজেক্ট এম কে আলট্রার কাঠামো
এমকে-আলট্রা কখনোই একটি একক পরীক্ষা ছিল না। বরং এটি ছিল একটি ছাতার মতো
কর্মসূচি, যার অধীনে ১৫০টিরও বেশি উপ-প্রকল্পে বিভিন্ন ছদ্মসংগঠনের মাধ্যমে
অর্থায়ন করা হয়েছিল। এই ছদ্মসংগঠনগুলো সিআইএ-কে গবেষক ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে গোপনে
অর্থ প্রদান করতে সহায়তা করত, যাতে গবেষণার পেছনের প্রকৃত উদ্দেশ্য জনসমক্ষে
প্রকাশ না পায়।
উপ-প্রকল্পগুলোতে বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছিল। নিচে এর কয়েকটি
নিয়ে আলোচোনা করা হলোঃ
সাইকোট্রপিক ড্রাগ টেষ্টিংঃ এই কর্মসূচিতে স্বেচ্ছাসেবক এবং অজান্তে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের ওপর
এলএসডি (LSD), মেস্কালিন, সাইলোসাইবিন, বারবিচুরেট, অ্যামফেটামিন, স্কোপোলামিনের
মতো বিভিন্ন নেশাজাতিয় এবং মনের মধ্যে বিভ্রম সৃষ্টীকারী (Hallucinogenic)
রাসায়নিকের পরীক্ষা করা হয়েছিল। গবেষকদের প্রধান লক্ষ্য ছিল এমন ওষুধ শনাক্ত করা
যা সন্দেহভাজন ব্যাক্তিদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়, বিশেষ কোন স্মৃতি মুছে
ফেলা বা তাদের মনে কর্তৃপক্ষের প্রভাব মেনে নেওয়ার ক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম হবে। এর
পাশাপাশি তারা এমন এক কৌশল খুঁজছিলেন যা কোনো প্রমাণ না রেখেই কাউকে শারিরিক এবং
মানসিকভাবে অক্ষম বা দুর্বল করে দিতে পারে।
হিপনোসিস এবং অবচেতন অবস্থায় মনকে নির্দেশ দেওয়াঃ এমকে-আলট্রা প্রজেক্টের সাথে জড়িত অনেক গবেষক এই বিষয়ে অনুসদ্ধান করতে
শুরু করেন যে হিপনোসিস (সম্মোহন) ব্যবহার করে ব্যাক্তির স্মৃতি প্রতিস্থাপন (একটি সত্যিকারের স্মৃতি মুছে দিয়ে তার জায়গায় একটি নকল বা কৃত্তিম স্মৃতি জুড়ে
দেওয়া) বা তার আচরনে পরিবর্তন আনা সম্ভব কি না।
গবেষকরা আরও নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করে দেখেন যে, মানুষকে এমনভাবে
প্রোগ্রামিং করা যায় কিনা, যাতে তারা অচেতন বা পরোক্ষ অবস্থাতেই
নির্দিষ্ট কাজ বা মিশন সম্পন্ন করতে পারে। এই ধরনের ধারণাগুলোই পরবর্তীতে
কল্পসাহিত্যে ম্যানচুরিয়ান ক্যান্ডিডেট হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।
ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি এবং ইন্দ্রিয়গত বিচ্ছিন্নতাঃ এই পরীক্ষাগুলো সংবেদন বিচ্ছিন্নতা (Sensory Deprivation,
উদাহরন হিসেবে বলা যায় একজন মানুষের চোখ কাপড় দিয়ে বেধে রাখা অথবা তাকে একটি
অন্ধকার এবং শব্দহীন ঘরে দীর্ঘসময় ধরে রাখা) ব্যবহার করে মানব মনের গঠন ভেঙে ফেলা বা পুনর্গঠন করার চেষ্টা করেছিল।
গবেষকরা তাদের গবেষনায় ব্যবহার করা লোকেদের মানসিক প্রতিরোধ (Psychological
Resistance) ভাঙতে তাদের দেহে বারবার ইলেকট্রোশক থেরাপিও (Electroshock Therapy,
একটি মানসিক চিকিৎসার পদ্ধতি যেখানে মস্তিষ্কের মধ্য দিয়ে অল্প পরিমানে
বৈদ্যুতিক প্রবাহ পাঠিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত খিঁচুনি ঘটানো হয়) প্রয়োগ করেছিলেন। অনেক ক্ষেত্রেই অংশগ্রহণকারীদের আবেগীয় ও জ্ঞানগত সীমা
অতিক্রম করানোর জন্য দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ (Prolonged Stress) ব্যবহার করা
হতো।
আচরণগত শর্তারোপ (Behavioral Conditioning)ঃ গবেষকদের একাংশ অনুসন্ধান করেছিলেন যে মানসিক আঘাত বা ট্রমা কীভাবে
ব্যক্তিত্বের প্রতিরক্ষামূলক কাঠামো ভেঙে ফেলতে পারে। তাঁরা আরও পর্যবেক্ষণ করেন
যে ঘুমের অভাব কীভাবে মানুষের মানসিক স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করে দিয়ে
তাদেরকে বিভিন্ন মতামত দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে।
একইভাবে, পরিবার, সমাজ এবং অন্যান্য মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা একজন ব্যক্তিকে
বাইরের প্রভাবের প্রতি আরও সংবেদনশীল করে তুলতে পারে।
রাসায়বনিক এবং জৈবিক অস্ত্রের ব্যবহারঃ প্রজেক্ট এমকে আলট্রার
অধিনস্ত কিছু উপ-প্রকল্পগুলোতে গোপন সামরিক এবং গোয়েন্দা অভিযানে রোগজীবাণু বা
বিষাক্ত উপাদান কীভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে, তা নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা চালানো
হয়েছিল। গবেষকেরা অনুসন্ধান করেছিলেন যে এই উপাদানগুলো অদৃশ্যভাবে লক্ষ্যবস্তুদের
অক্ষম করে দিতে পারে কি না। তারা এসব উপাদানের গুপ্তহত্যা (Assassination) বা
জিজ্ঞাসাবাদ–সংক্রান্ত ব্যবহারের সম্ভাবনাও অনুসন্ধান করেছিলেন।
সেইফ হাউসে ফিল্ড টেস্টিং করাঃ আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটি ও সান ফ্রান্সিসকো শহরে সিআইএ পরিচালিত
সেইফ হাউস গুলো (যেমন
অপারেশন মিডনাইট ক্লাইম্যাক্সের
অধীনে পরিচালিত স্থাপনাগুলো) নাগরিকদের উপরে গোপন আচরণগত পরীক্ষা চালানোর জন্য
ব্যবহৃত হতো। এসব স্থাপনায় সাধারন নাগরিকদের তাদের অজ্ঞাতসারে তাদেরকে প্রায়ই
যৌন ফাঁদে ফেলার কৌশলের সঙ্গে মিলিয়ে মাদক দেওয়া হতো। এর মূল লক্ষ্য ছিল
নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষাগারের বাইরে বাস্তব পরিবেশে মাদক দ্রব্য সেবনের পরে মানুষের
মানসিক ও আচরণগত প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা।
এমকে-আলট্রা (MK-ULTRA)-তে অংশ নেওয়া সব গবেষকই জানতেন না যে তাঁরা একটি সিআইএ
এর অধীনে এক গোপন কর্মসূচিতে অবদান রাখছেন। এসব প্রকল্পের পেছনের কে টাকা খরচ
করছে সে ব্যাপারে স্ট্যানফোর্ড, হার্ভার্ড এবং জনস হপকিন্সের মতো
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সচেতন ছিল না বলে তারা দাবী করে থাকে। আবার অনেক গবেষকেরা
জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে নৈতিকভাবে সন্দেহজনক এসব পরীক্ষাগুলো
পরিচালনা করেছিলেন।
মানুষের উপরে প্রায়োগিক গবেষনাঃ অনিচ্ছুক অংশগ্রহণকারী ও নৈতিক বিপর্যয়
এমকে-আলট্রা (MK-ULTRA)-এর সবচেয়ে বিস্ময়কর দিকগুলোর মধ্যে একটি ছিল
মানব-পরীক্ষার ব্যাপকতা এবং তার কঠোরতা। যদিও কিছু পরীক্ষা এমন স্বেচ্ছাসেবকদের
ওপর চালানো হয়েছিল, যারা ভেবেছিলেন তারা সাধারণ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অংশ নিচ্ছেন;
তবে অনেক পরীক্ষাই এমন ব্যক্তিদের ওপর পরিচালিত হয়েছিল যারা জানতেই পারেননি যে
তাদের মাদক দেওয়া হচ্ছে বা অন্যভাবে প্রভাবিত করা হচ্ছে। এই অজান্তে ব্যবহৃত
ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন কারাগারের বন্দি, মানসিক রোগী, হাসপাতালের রোগী, মাদক
আসক্ত ব্যক্তি, সৈনিক এবং সাধারণ নাগরিকরা।
এমকে-আলট্রা (MK-ULTRA)-এর সবচেয়ে কুখ্যাত ভুক্তভোগীদের একজন ছিলেন
যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর বায়োকেমিস্ট ড.
ফ্র্যাঙ্ক ওলসন। ১৯৫৩ সালে সিআইএ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তার অজান্তেই তাকে এলএসডি (LSD) দেওয়া
হয়েছিল। এর পর ওলসন তীব্র মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হন এবং নয় দিন পর একটি
হোটেলের জানালা থেকে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। সিআইএ প্রথমে এই মৃত্যুকে আত্মহত্যা
বলে দাবি করলেও, পরবর্তী তদন্তে সম্ভাব্য দুরভিসন্ধি ও গোপন তৎপরতার ইঙ্গিত মেলে।
এই ঘটনা বহু দশক ধরে আইনি লড়াই ও জনমনে বিতর্কের সৃষ্টি করে।
অন্যান্য নির্যাতনগুলো ছিল আরও ভয়াবহ। মন্ট্রিয়লের অ্যালেন মেমোরিয়াল
ইনস্টিটিউটে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. ইউয়েন ক্যামেরন
সাইকিক ড্রাইভিং
নামে পরীক্ষাগুলো পরিচালনা করেন। তাঁর এই পরীক্ষাগুলোতে রোগীদের ব্যক্তিত্ব
ডিপ্যাটার্ন (ভেঙে ফেলে) করে নতুনভাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তাঁদের ওপর
অসংখ্য তীব্র ইলেকট্রোশক থেরাপি, সংবেদন-বঞ্চনা, ওষুধপ্রণোদিত কোমা এবং একই
বার্তা বারবার শোনানোর মতো পদ্ধতি প্রয়োগ করা হতো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অনেক রোগী
এই পরীক্ষাগুলো থেকে স্মৃতিভ্রংশ (Amnesia), মস্তিস্কের ক্ষতি অথবা দীর্ঘমেয়াদি
মানসিক আঘাত নিয়ে বেরিয়ে আসেন।
এই পরীক্ষাগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত নৈতিক নীতিমালা (বিশেষ করে
মানব-গবেষণায় সচেতন সম্মতি ও অংশগ্রহণকারীদের সুরক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া
ন্যুরেমবার্গ কোড (Nuremberg Code)) স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করেছিল। পরিহাসমূলক ভাবে,
এমকে-আলট্রা-এর কিছু গবেষণা সরাসরি নাৎসি ও জাপানি যুদ্ধাপরাধ থেকে প্রেরণা
পেয়েছিল, যেখানে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা
অপারেশন পেপারক্লিপের বিজ্ঞানী এবং
ইউনিট ৭৩১ এর তথ্য থেকে আহরিত জ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল।
*** অপারেশন পেপারক্লিপ (Operation Paperclip) ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি
গোপন গোয়েন্দা কর্মসূচি, যার মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপে শেষ হওয়ার পর
১,৬০০-এরও বেশি জার্মান বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী এবং প্রযুক্তিবিদকে প্রাক্তন নাৎসি
জার্মানি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি চাকরিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ।
*** ইউনিট ৭৩১ (Unit 731) ছিল ইম্পিরিয়াল জাপানিজ আর্মি-র একটি গোপন জৈব ও
রাসায়নিক যুদ্ধ গবেষণা ও উন্নয়ন ইউনিট, যা ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত অধিকৃত
চীনে হাজার হাজার মানুষের ওপর নৃশংস ও মারাত্মক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা পরিচালনা
করেছিল ।
বৈজ্ঞানিক উচ্চাকাঙ্খা, প্যারানয়া এবং ছদ্মবিজ্ঞান
এমকে আলট্রা প্রকল্পে কাজ করা গবেষকেরা একে মানব মন নিয়ন্ত্রন করার জন্য একটি
গুরুত্বপুর্ন ধাপ হিসেবে দেখে থাকলেও, বাস্তবে এর অধিকাংশ গবেষনা পদ্ধতিগুলো
বৈজ্ঞানিক ভাবে অযৌক্তিক ছিল। এই প্রজেক্টের অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পগুলো কঠোর
গবেষণার চেয়ে ভয় ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার দ্বারা বেশি পরিচালিত ছিল। মানুষের মনকে
নিয়ন্ত্রন করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করার ব্যাপারে সিআইএ-র আকাঙ্ক্ষা সে সময়ের
মনোবিজ্ঞান বা স্নায়ুবিজ্ঞানের প্রকৃত সক্ষমতার অনেক ঊর্ধ্বে ছিল। যার ফলে
এই প্রোগামের অধীনে চলতে থাকা বহু পরিক্ষা এলোমেলোভাবে পরিকল্পিত, দুর্বলভাবে
নথিবদ্ধ, অথবা যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই পরিচালিত হয়েছিল।
এমকে-আল্ট্রা (MK-ULTRA) অনৈতিক উপায়ে পরিচালিত হওয়া সত্ত্বেও এটি বেশ কিছু বৈধ
বৈজ্ঞানিক আবিস্কারে অবদান রেখেছিল। এই প্রকল্পটি কাকতালীয় ভাবে সাইকেডেলিকস
বিষয়ক গবেষণার অগ্রগতি ত্বরান্বিত করে, বিশেষ করে এলএসডি-এর চিকিৎসাগত সম্ভাবনা
নিয়ে প্রাথমিক অধ্যয়নগুলোকে প্রভাবিত করে। মনোবিজ্ঞান ও মনোরোগবিদ্যার বেশ
কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব (যেমন
টিমোথি লিয়ারি
এবং হার্ভার্ডের অন্যান্য গবেষকরা) এমকে-আল্ট্রার প্রকল্প থেকে তাদের নিজস্ব
গবেষনার জন্য অনুদান পান এবং পরবর্তিতে তারা গুরুতর মনোরোগের চিকিৎসার জন্য এল
এস ডি ব্যবহার করার জন্য ডাক্তাদের অনুপ্রানিত করেন।
মানবচেতনাকে সহজ কোনো রাসায়নিক বা মনস্তাত্ত্বিক উপকরণের মাধ্যমে
নির্ভরযোগ্যভাবে নিয়ন্ত্রণ বা পুনর্গঠন করা সম্ভব - এমন ভ্রান্ত ধারনার মধ্যেই
এমকে-আল্ট্রার প্রকল্পের সর্বাত্মক বৈজ্ঞানিক ব্যর্থতা লুকিয়ে ছিল। প্রায় এক দশক
ধরে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরিক্ষা চালিয়েও সিআইএ মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য
কোনো কার্যকর পদ্ধতি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। এই প্রকল্পে অংশ নেওয়া অধিকাংশ
অংশগ্রহণকারী এলএসডি-র মতো মাদকদ্রব্য সেবন করার পরে ব্যাক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন
প্রতিক্রিয়া দেখায়, যা জিজ্ঞাসাবাদ বা গুপ্তচরবৃত্তিতে এর সম্ভাব্য ব্যবহারকে
দুর্বল করে দেয়। ধারাবাহিক ফলাফল তৈরির অক্ষমতাই শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটির
পতনে ভূমিকা রাখে।
এমকে আলট্রার রহস্য উন্মোচন এবং চার্চ কমিটির শুনানী (Church Committee Hearings)
এমকে-আল্ট্রার রহস্য হয়তো চিরতরে গোপনই রয়ে যেত, যদি ১৯৭০-এর দশকে আমেরিকায়
সংবাদপত্রে ধারাবাহিক ভাবে গোপন তথ্য ফাঁস, এগুলোকে নিয়ে সরকারি এবং সংসদীয়
কমিটির তদন্ত এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের ঘটনা না ঘটত।
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির
পর সরকারের উপরে আমেরিকার জনগনের আস্থা এবং বিশ্বাস তীব্রভাবে কমে যায়, যা
আমেরিকান সরকারের দ্বারা সংঘটিত অতীতের অপব্যবহারগুলো উন্মোচনের জন্য একটি অনুকূল
পরিবেশ তৈরি করে দেয়।
বাড়তে থাকা নজরদারির মাঝেই, ১৯৭৩ সালে সিআইএ পরিচালক রিচার্ড হেলমস
এমকে-আল্ট্রার অধিকাংশ নথি ধ্বংসের নির্দেশ দেন। সৌভাগ্যবশত, প্রায় ২০,০০০ নথি
টিকে যায়, কারণ সেগুলো ভুলবশত আর্থিক নথিপত্রের আর্কাইভে সংরক্ষিত ছিল।
১৯৭৫ সালে
চার্চ কমিটি
ব্যাপক গনশুনানির আয়োজন করে, যা এমকে-আল্ট্রা প্রজেক্টকে জনগনের কাছে তুলে আনে।
এই শুনানিতে ভুক্তভোগী ও হুইসলব্লোয়াররা তাঁদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন, আর বেঁচে
থাকা সিআইএ কর্মকর্তারা স্বীকার করেন যে তাঁরা এই প্রকল্প পরিচালনা করেছিলেন। এসব
গোপন তথ্য প্রকাশের ফলে বিশ্বের লোকেদের কাছে শুধু এমকে আলট্রার মতো বেআইনি
পরীক্ষা নিরিক্ষাই নয়, বরং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভেতরের সুসংগঠিত গোপনীয়তার
সংস্কৃতিও প্রকাশ হয়ে যায়।
আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড পরবর্তীতে একটি নির্বাহী আদেশ জারি
করেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের অনুমতি ছাড়া তাদের ওপর মাদক প্রয়োগ বা
পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিষিদ্ধ করে। পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম
নিয়ন্ত্রণে নতুন নজরদারি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। সিআইএ আনুষ্ঠানিকভাবে
এমকে-আল্ট্রা এবং অনুরূপ প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দেয়, যদিও সংশয়বাদীরা যুক্তি দেন
যে কিছু গবেষণা ভিন্ন নামে বা আরও গোপন আকারে চলতে থাকে।
***
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিঃ এই ঘটনাটি শুরু হয় ১৯৭২ সালের ১৭ জুন, যখন তৎকালীন
আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ১৯৭২ সালের পুনর্নির্বাচন প্রচারণার
সাথে যুক্ত একটি দলের সদস্যরা ওয়াশিংটন, ডিসির ওয়াটারগেট কমপ্লেক্সে
ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির সদর দপ্তরে চুরি এবং শোনার যন্ত্র স্থাপন করার
সময় ধরা পড়ে।
***
চার্চ কমিটিঃ চার্চ কমিটি (আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট
সিলেক্ট কমিটি টু স্টাডি গভর্নমেন্টাল অপারেশনস উইথ রেসপেক্ট টু ইন্টেলিজেন্স
অ্যাক্টিভিটিস ) ছিল ১৯৭৫ সালে মার্কিন সিনেটের একটি সিলেক্ট কমিটি যা
সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ), ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি (এনএসএ),
ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এবং ইন্টারনাল রেভিনিউ সার্ভিস
(আইআরএস) দ্বারা অপব্যবহারের তদন্ত করেছিল।
এমকে আলট্রা প্রজেক্টের আইনগত এবং নৈতিক পরিনতি
এমকে আলট্রা প্রজেক্টের খবর জনসাধারনের কাছে প্রকাশিত হওয়ার পরে এই প্রজেক্টের
শিকার হওয়া ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা ক্ষতিপূরণের দাবিতে সরকারের বিরুদ্ধে আদালতে
অসংখ্য মামলা দায়ের করেন। যদিও কিছু মানুষ সমঝোতার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ পান,
তারপরেও বহু মামলা আইনগত খুঁটিনাটির কারণে (যেমন জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার ভয়ে বা মামলা করার আইনগত সময়সীমা অতিক্রম
হয়ে যাওয়া ) খারিজ হয়ে যায়।
ওলসন পরিবার ১৯৭৫ সালে সরকারের কাছ থেকে দুঃখপ্রকাশ এবং আর্থিক ক্ষতিপূরণ পায়।
কিন্তু অনেক ভুক্তভোগী, বিশেষ করে যারা কারাগার বা মনোরোগ প্রতিষ্ঠানগুলোতে
শোষণের শিকার হয়েছিলেন, তারা কখনও স্বীকৃতি বা ন্যায়বিচার পাননি।
নৈতিকভাবে, প্রজেক্ট এমকে আলট্রা বৈজ্ঞানিক গবেষনায় মানবদেহ নিয়ে পরীক্ষা
সংক্রান্ত আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এটি এই ব্যাপারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর (যেমন, মানসিক রোগী, জেলখানার কয়েদি ইত্যাদি) দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে তুলে ধরে এবং বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন
পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে সুস্পষ্ট সম্মতি (Informed Consent) আদায় করা,
গবেষনার স্বচ্ছতা ও ইনস্টিটিউশনাল রিভিউ বোর্ডের (IRB)-এর প্রয়োজনীয়তাকে
পুনরায় নিশ্চিত করে।
সবশেষে এমকে আলট্রা কেলেঙ্কারিতে উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন একাডেমিক
প্রতিষ্ঠানগুলোও সমালোচনার মুখে পড়ে, কারণ তারা যথাযথ নৈতিক সুরক্ষা ছাড়াই
সিআইএ-অর্থায়িত গবেষণায় সচেতনভাবে বা নিজেদের অজান্তেই অংশগ্রহণ করেছিল।
সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং একে নিয়ে তৈরি হওয়া ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
এমকে-আল্ট্রা জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। এটি অসংখ্য বই, চলচ্চিত্র,
তথ্যচিত্র এবং কল্পকাহিনিকে অনুপ্রাণিত করেছে, যেখানে মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ,
সরকারি গোপনীয়তা এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বিস্তারের মতো বিষয়গুলো নিয়ে
অনুসন্ধান করা হয়েছে।
দ্য ম্যানচুরিয়ান ক্যান্ডিডেট,
স্ট্রেঞ্জার থিংস,
জেসন বর্ন
এবং বিভিন্ন ষড়যন্ত্র-ভিত্তিক থ্রিলারের মতো কাজগুলো সরাসরি বা পরোক্ষভাবে
এমকে-আল্ট্রার নথিভুক্ত ইতিহাস থেকে প্রেরণা পেয়েছে।
এমকে আলট্রা প্রজেক্টের এরকম সাংস্কৃতিক প্রভাব নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জন্ম
দিয়েছে, যার কিছু আবার প্রকল্পটির সক্ষমতাকে অতিরঞ্জিত বা বিকৃত করে উপস্থাপন
করে। এই প্রকল্পটি নিঃসন্দেহে গুরুতর মানব অধিকার লঙ্ঘন করার জন্য দায়ী হলেও, এটি
যে মানুষের মনকে সম্পূর্ন রকম ভাবে নিয়ন্ত্রন করতে সফল হয়েছে এমন কোন প্রমান
পাওয়া যায়নি। তবুও গোয়েন্দা কার্যক্রমকে ঘিরে থাকা গোপনীয়তা এখনো অনেক কৌতূহলী
মনে জল্পনা-কল্পনার জন্ম দেয়, যা দেখায় যে সরকারি সংস্থাগুলোর উপর জনগনের
বিশ্বাস উঠে গেলে তা কতটা দীর্ঘস্থায়ী পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
সরকারি গোপনীয়তা এবং জনগনের বিশ্বাসের উপরে এমকে আলট্রার প্রভাব
এমকে-আল্ট্রার সবচেয়ে স্থায়ী উত্তরাধিকারের (legacy) একটি হলো সরকারি
প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগনের বিশ্বাস রাখার ওপর এর গভীর প্রভাব। এই প্রকল্প
দেখিয়েছিল কীভাবে গোপনীয়তা, ভয় এবং অযাচিত ক্ষমতা মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম
উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে। বহু দশক পরেও এমকে-আল্ট্রা এখনো সরকারী ক্ষমতার
অপব্যবহার, গোপন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গোয়েন্দা সংস্থার জবাবদিহিতা বিষয়ক
আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স হিসেবে রয়ে গেছে।
এই প্রকল্প মানব চেতনার প্রকৃতি, স্বায়ত্তশাসন এবং মানবিক দুর্বলতা সম্পর্কে
গভীর দার্শনিক প্রশ্নও উত্থাপন করে। মানব মস্তিষ্ক, যা অনেকের কাছে ব্যক্তিগত
স্বাধীনতার শেষ সীমানা, কোনো সরকারি সংস্থা তা ভেদ করার চেষ্টা করেছে, এমন ধারণা
আমাদের সকলের কাছেই অস্বস্তিকর হিসেবে প্রতীয়মান হবে। এমকে-আল্ট্রা আমাদেরকে মনে
করিয়ে দেয় যে প্রযুক্তিগত বা বৈজ্ঞানিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা যখন নৈতিক নীতিমালা থেকে
বিচ্ছিন্ন হয়, তখন তা নৈতিক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
শেষ কথা
প্রজেক্ট এমকে-আল্ট্রা ছিল আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত ও নৈতিকভাবে
নিন্দনীয় কর্মসূচিগুলোর মধ্যে একটি। শীতল যুদ্ধের সন্দেহপ্রবণতার মধ্যে এটি মানব
চেতনার রহস্য উন্মোচন এবং মানুষের মনকে ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রনের লক্ষ্য নিয়ে তৈরি
করা হয়েছিল। অনিচ্ছুক বেসামরিক মানুষ, বন্দি, রোগী এবং এমনকি সরকারি কর্মচারীদের
ওপর পরিচালিত গোপন পরীক্ষার মাধ্যমে এটি শারীরিক এবং মানসিক যন্ত্রণা, বৈজ্ঞানিক
অনিয়ম এবং গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি উদাহরন সৃষ্টি করেছে, যা অনিয়ন্ত্রিত
ক্ষমতা ও গোপন পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিপদের একটি কঠোর সতর্কবার্তা হিসেবে রয়ে
গেছে।
এমকে-আল্ট্রার প্রকাশ গবেষণার নীতি এবং গোয়েন্দা তদারকিতে গুরুত্বপূর্ণ
সংস্কারের সূচনা করলেও এটি বহু অনিরসনীয় প্রশ্ন ও দীর্ঘস্থায়ী অবিশ্বাসের
পরিবেশ রেখে যায়। এমকে-আল্ট্রার মতো প্রকল্পগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে
জ্ঞানের অনুসন্ধান কখনোই মানব মর্যাদা ও নৈতিক দায়িত্বের বিনিময়ে হওয়া উচিত
নয়, এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ একটি সমাজকে
অবশ্যই সেই সব শক্তির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে যারা এসব মূল্যবোধকে সমাজের ভেতর
থেকেই দুর্বল করে দিতে চায়।



অতিপ্রাকৃতিক ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url